সমস্ত লেখাগুলি

One way Rationalism, One way Humanism -
সন্তোষ শর্মা
Nov. 19, 2024 | আইন | views:882 | likes:2 | share: 2 | comments:0

২০১৯ সালের ৩ জুন “ ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি”র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি এবং পুরুলিয়া শাখার সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো,  সিধু কানু বিরষা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Sidhu-kanho-Birsha University) ভাইস চ্যান্সেলর এবং রেজিস্টারকে তাদের বিভিন্ন ফর্ম (Form)-এ ধর্মীয় (Religion) কলামে মানবতাবাদ বা মানবধর্ম রাখার আবেদন জানান।

 স্বাভাবিক ভাবেই অনেকে হয়তো ভাববেন, বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে ৪২০০টি প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম (Religion) থাকতে হটাৎ মানবধর্ম কেন বা কি প্রয়োজনে? অথবা, এই মানবধর্ম বিষয়টি আদতে ঠিক কি?

দেখা যাচ্ছে, সমস্ত প্রতিষ্ঠানিক ধর্মেই নিজেদের কে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী জানায়। মানবতা এবং পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার লোকদেখানো প্রচারও করে থাকে কিন্ত সেটাই যদি সত্য হতো তাহলে ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে হিংসা, বিদ্বেষ, রক্তপাতের খবর শোনাই যেতো না। ‘ধর্ম মানবতা শেখায়’ কথাটা আসলে সোনার পাথরবাটির মতন ব্যপার। এটি সর্বৈব মিথ্যে এবং অপপ্রচার।

প্রথম মানবধর্ম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৯ সালে নিউইয়র্কে। অর্থাৎ রাষ্ট্রসংঘের অধিকার ঘোষণার অনেক আগে। এই মানবধর্মীরা তখন ধর্মগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ১৯২৯ সালে পাশ্চাত্যে “Humanism” নামে যে নতুন Ism বা মতবাদের জন্ম হয়েছিল সেটা ছিল ইহুদি- খ্রিস্টান কট্টর পন্থীদের অবিরাম সংঘর্ষের একটা ফলস্বরূপ। তখনকার গণ্যমান্যরাই ছিলেন এই দলে। এঁরা মানবধর্মকে অন্য সমস্ত প্রচলিত ধর্মের বিকল্প হিসেবে চেয়েছিলেন। এদের উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন Albert Einstein, Will Durant, Thomas Mann, Julian Huxley  ইত্যাদি জ্ঞানী গুণী যোদ্ধারা। এদের পথপ্রদর্শক ছিল আধুনিক প্রকৃতিবিজ্ঞান। তাদের আস্থা ছিল, প্রত্যয় ছিল কিন্তু ছিল না অন্ধবিশ্বাস। তাদের আস্থা ছিল গণতন্ত্রে, বিজ্ঞানে, সব মানুষের সমান অধিকারে।

এখন এই ধর্মীয় স্বাধীনতার যুগে অনেক বিশ্বাস বা Cult যা ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে উঠে এসেছে, তাঁরা আলাদা স্বীকৃতি চাইছেন। যেমন রামকৃষ্ণের ভক্তরা “Ramkrishnaite” হিসেবে আলাদা ধর্মীয় স্বীকৃতি চাইছিলেন বেশ কিছু বছর ধরেই। কিন্তু তাঁরা মূলত হিন্দু বলেই তাঁদের এই আবেদন বাতিল করে দেয় সরকার। অবাক লেগেছিল যখন একজন সফল আবেদনকারীর চাকরিতে ঢোকা নাকচ হয়ে যায় শুধুমাত্র “Religion”  কলামে “মানবতাবাদ” লেখার জন্য। যেন মানবিক হওয়াটা খুব গর্হিত অপরাধ।

সেটা ১৯৯২-৯৩ সাল। যুক্তিবাদী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এই বাংলার ছেলে মেয়েরা সরকারি, বে-সরকারি সমস্ত আবেদনপত্রে “ধর্ম” কলাম তুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। “ধর্মপালন বা ধর্মাচরণ কারোর ব্যক্তিগত ব্যপার, একটি ধর্মনিরপক্ষে রাষ্ট্রে ধর্মীয় পরিচয় জানানো জরুরি নয়। যাঁরা কোন প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম মানেন না তাঁদের form বাতিল করা হচ্ছে অসম্পূর্ণ বলে। এই সময় এগিয়ে আসে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সিস্টার কনসার্ন “Humanists Association of India” বা “ ভারতের মানবতাবাদী সমিতি” এবং সক্রিয় হয় মানবতাকে ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে।

মানবতাবাদী সমিতি সরাসরি চিঠি পাঠায় রাষ্ট্রসংঘের অফিসে। উত্তরও আসে দেরি না করেই। UNO তাদের Human Rights এবং Religious Rights সংক্রান্ত যাবতীয় বই ও কাগজপত্র পাঠিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ‘১৯৮১-র জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে রাষ্ট্রসংঘ ঘোষণা করেছে প্রতিটি মানুষের যে কোনো ধর্মমত গ্রহণ করার ও চর্চা করার স্বাধীন অধিকার আছে।’ তারপরই এই আইনি লড়াইতে যৌথভাবে নেমে পড়ে মানবতাবাদী সমিতি ও যুক্তিবাদী সমিতি। একটা চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, সাংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও বিদেশি দূতাবাসেও। তারপর মানবতাবাদী সমিতি’র সহায়তায় কোর্টে গিয়ে Affidavit করে দলে দলে  ছেলেমেয়ে Humanism-কে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে ১৯৯৩ সালে ১০ ডিসেম্বর। ১৯৯৩ সালে ১০ ডিসেম্বর “বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে” প্রথম ৫৪ জন সদস্য-সদস্যা আইনিভাবে Humanist হন।

এই কঠিন লড়াইটা জেতার পর এখন আর কোন বাধা নেই– যে কোন রাষ্ট্রসংঘের সদস্য দেশে এই একই ভাবে যে কেউ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে HUMANIST ঘোষণা করতে পারেন সগর্বে।

প্রসঙ্গত জানাই, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে বোম্বে হাইকোর্ট একটি রায়ে স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছে, রাষ্ট্র কাউকে তার ধর্ম জানাতে বাধ্য করতে পারবে না। তিনি কোনও ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নন বা কোনও ধর্ম পালন করেন না -- এই দাবী করার সাংবিধানিক অধিকার আছে প্রত্যেক নাগরিকের। (State can compel none to declare or specify his/her religion. Citizens have Constitutional Right to belong to 'No Religion'.----- Bombey H C Ruling.

এটি পড়ুন –

 No person in India can be compelled to declare his religion: HIGH COURTS

Bombay High Court: In a landmark judgment, a bench comprising of A.S. Oka and A.S. Chandurkar, JJ declared that by virtue of Article 25 of the Constitution, every individual has the right to claim that he does not practice or profess any religion and thereby directed the state that they cannot compel any individual to declare or specify his religion in any form or in any declaration.


In the present case the petitioners were members of a registered organization “Full Gospel Church of God”.  Though they believed in the existence of Lord Jesus Christ but they did not believe in any religion, much less Christianity. According to their belief, Lord Jesus Christ desired to have a kingdom of heaven and not to form any religion. Therefore, they wanted a gazette notification to be issued recording that they were not Christians and that they belong to ‘no religion’. This application was rejected by Government Printing Press against which they filed a public interest litigation in Court.


The Court took into consideration various judgments including Commissioner of Police v. Acharya Jagadishwarananda Avadhuta (2004) 12 SCC 770 where it was stated that ‘man’s relation to his God is no concern of the State’. The Bench also observed that Article 25 (1); of the Constitution is in two parts. The first part confers fundamental right to freedom of conscience whereas the second part confers a right on a citizen to freely profess, practice or propagate any religion. The Court clarified that as freedom of conscience confers a fundamental right to entertain a religious belief, it also confers a right on an individual to express an opinion that he does not belong to any religion. Therefore, no authority which is a state within the meaning of Article 12 or any of its agency or instrumentality can infringe the fundamental right to freedom of conscience and thereby, the Court set aside the order of the Government Printing Press. Dr. Ranjeet Suryakant Mohite vs. Union of India, Public Interest Litigation No. 139 of 2010, decided on 23.09.2014

News Link: https://www.scconline.com/blog/post/2014/09/26/no-person-in-india-can-be-compelled-to-declare-his-religion/

এখানে আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ খবর তুলে ধরলাম।


“ইচ্ছামতো ধর্ম গ্রহণ ভারতে।”

ইনকিলাব ডেস্ক। প্রকাশের সময়: ১১ এপ্রিল, ২০২১

১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কোনো নাগরিক তার ইচ্ছামতো ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে বলে সংবিধানে অধিকার দেয়া রয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। শুক্রবার ভারতের উচ্চ আদালতে অশ্বিন উপাধ্যায় নামে আইনজীবীর আবেদনের প্রতিউত্তরে এমন মন্তব্য করেছেন। এছাড়া এ বিষয়ে ‘এরকম ক্ষতিকর’ পিটিশন করার জন্য নিন্দাও জানিয়েছে আদালত। অশ্বিনের আবেদন ছিল, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মান্তরকরণ বন্ধের জন্য সর্বোচ্চ আদালত কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোকে যেন নির্দেশ দেয়। সংবিধান বিরোধী এমন আবেদন করায় অশ্বিনের আইনজীবী গোপাল শঙ্কর নারায়ণকে নিন্দা জানিয়েছেন বিচারপতি আর এফ নরিম্যান, বি আর গাভাই ও ঋষিকেশ রায়কে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের বেঞ্চ। বিচারপতিরা বলেন, একজন সিনিয়র আইনজীবী হওয়ার পরও সংবিধানে নাগরিকদের অধিকারের বিষয়ে জানা নেই আপনার। যদি না জানেন তাহলে আবেদনকারীর প্রতিনিধিত্ব করার আগে তা জেনে নিতে পারেন। এভাবে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য আমরা আপনার এবং আপনার নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারি। সূত্র- দ্য হিন্দু।

 খবরটির লিংক - https://m.dailyinqilab.com/article/372707/%E0%A6%87%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A7%8B-%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE-%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A6%A3-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87


আমজনতার বৃহৎ অংশ 'ধর্ম' বলতে উপাসনা / প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ বলতে উপাসনাধর্ম বিষয়ক বই-পত্র কেই বোঝেন। অভিধানে ‘ধর্ম’ বা ‘ রিলিজিয়ন’ (Religion) শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে - (১) ধর্ম মানে - সাম্প্রদায়িক, ঈশ্বর উপাসনা, রীতি-নীতি, ঈশ্বর এবং পরলোকের অস্তিত্বে বিশ্বাস। যেমন -হিন্দু, খ্রীষ্টান, ইসলাম ইত্যাদি ৪২০০ প্রকার। (২) Religion [ রিলি'জন ]n. ধর্ম:  human recognition of a personal God entitled to obedience.. আবার, (৩) ধর্ম মানে - গুণ (Property) বৈশিষ্ট (Characteristic)। যেমন - আগুনের ধর্ম বা গুণ দহন, জলের ধর্ম বা গুণ তরলতা, তরোয়াল এর ধর্ম বা গুণ তীক্ষ্ণতা ইত্যাদি। ধর্মবিশ্বাস ; any system of faith and worship বোঝায়।

বহু ব্যক্তিরা এই প্রশ্নটিও তোলেন যে, কি এই মানবতাবাদ অথবা HUMANISM? কেন মেনে নেবো একে? এর উত্তরটি বেশ সহজ। HUMANISM কে ভাঙ্গলে আমরা কি পাই দেখা যাক। HUMAN অর্থাৎ ‘মানব’ বা মানুষ এবং ism হচ্ছে ‘মতবাদ’। দুয়ে মিলে দাঁড়ায়, মানবের মতবাদ কিংবা একজন মানুষের নিজস্ব মতবাদ এবং একজন মানুষের নিজস্ব মতবাদ কখনওই জন্মসূত্রে পাওয়া প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম (Religion) যেমন- হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি পরিচয় হতে পারে না। কারন, একটি শিশু যখন জন্ম নেয় তখন সে জানেই না তার ধর্মচিহ্ন বা ধর্মবিশ্বাস ঠিক কি। শিশুটি জানেই না, জাতপাত, ধর্মীয় আচার আচরণ, ধর্মীয় বিদ্বেষ কাকে বলে। শিশুটি শুধু জানে প্রাণখুলে খেলতে, আনন্দে বাঁচতে। একটি শিশুর মস্তিষ্ক মাটির তালের ন্যায়। কুমোর যেমন চরকায় মাটির তাল ফেলে ইচ্ছেমত আকার দেয় তেমনই পরিবারের শিশুদের গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন তাদের অভিভাবকেরা। কেউ, ছোট থেকেই শিশুদের ধর্মহীন, জাতপাতহীন মুক্তমনা গড়তে চেষ্টা করেন তো কেউ আবার ধার্মিক। মানবতাবাদ=নাস্তিকতাবাদ + মানবিক গুণ।


তাই যিনি নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী যুক্তিবাদী নন তিনি মানবতাবাদী হতে পারেননা, তিনি মানবিক গুনসম্পন্ন ব্যক্তি হতে পারেন কিন্তু মানবতাবাদী নন।

উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, “বর্তমান যুগে যারা শুধু বিজ্ঞান ও বির্বতনকে বিশ্বাস করে তারা মানবধর্ম পালন করে। তারা স্বাধীন।তারা আধুনিক বিজ্ঞানকে আর্দশ মনে করে। মানব ধর্মে বিশ্বাসীগণ নাস্তিক নামেও পরিচিত,কারণ তারা আদিমকালের কোন ধর্মই বিশ্বাস করে না, পালন করে না। ৭৭১.৫০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মানবধর্মে বিশ্বাসী পুরো পৃথিবীতে ২০ কোটি প্রায়। মানব ধর্মের উল্লেখ, কবি ‘লালন শার্হ’ তার কবিতায় বলেছেন। তিনি চেয়েছেন ধর্ম, জাত, বর্ণের কোন ভেদাভেদ না রেখে সবাই মানবধর্মে মনোযোগ দেই, মানবধর্ম পালনে বিশ্বাসী হই।”

 এই প্রসঙ্গে জানাতে চাই, Humanitarianism আর Humanism এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। Humanism বা মানববাদ মানুষের বৌদ্ধিক চেতনা নিয়ে কথা বলে। অপরদিক Humanitarianism মানুষের মানবিক গুণাবলী  যেমন প্রেম ভালোবাসা, দয়া, দায়িত্বশীলতা ইত্যাদির কথা বলে।

আজ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার বিচারে নাস্তিক /অধার্মিক / যুক্তিবাদীরা তৃতীয় স্থানে (সূত্র- মনোরমা ইয়ারবুক ২০১৯। যাকে মান্যতা দেয় ওয়ার্ল্ড অ্যালম্যানাকও)। ২০১২ সালের ‘উইন গ্যালপ গ্লোবাল ইনডেক্স অফ রিলিজিয়ন রিপোর্ট’ অনুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশ ছিল ঘোষিত নাস্তিক। এই হিসেবে ১৩০ কোটির দেশ ভারতে নাস্তিকদের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৯০ লক্ষ। অন্যদিকে, অনেকে দেশে এখন নাস্তিকরাই সংখ্যাগুরু, এ তথ্য ছাপা হয়েছে শারিয়াপন্থী দলগুলোর সমর্থক দৈনিক ‘আমার দেশ’ এ, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬, গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল জরিপ।


 

ইউরোপের অনেকে দেশে এখন নাস্তিকরাই সংখ্যাগুরু। চীনে ৬১ শতাংশ সরাসরি স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে। সুইডেনে ৮ শতাংশ উপাসনালয়ে ধর্মচর্চা করে, ৭৬ শতাংশ নাস্তিক।

চেক প্রজাতন্ত্রে ১২ শতাংশ গির্জায় ধর্মচর্চা করে, ৭৫ শতাংশ নাস্তিক। ব্রিটেনের ৫৩ শতাংশের ধর্মবিশ্বাস নেই। হংকংএর নাগরিকদের ৬২ শতাংশে কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয়। জাপানে নাস্তিকের সংখ্যা ৬২ শতাংশ। জার্মানিতে ৫৯ শতাংশ নাস্তিক। স্পেনের নাগরিকদের বড় একটা অংশই নাস্তিক। অস্ট্রিয়ার নাগরিকদেরও বড় অংশ নাস্তিক। ফ্রান্সের নাগরিকদের বৃহত্তর অংশ নাস্তিক।

এসব তথ্য এটাই কি প্রমাণ করে না যে, নাস্তিক / অধার্মিক / যুক্তিবাদী / মানবতাবাদীদের বিশ্বজয় নিশ্চিত। যতই কট্টরপন্থী, মৌলবাদীরা অস্ত্রের প্রয়োগে মুক্তচিন্তকদের হত্যা করুক তবুও তাদের দুর্বার গতিকে আটকানোর নেই সাধ্য কারোরই। রইলো আরেকটি মন ভালোকরে দেওয়া খবর-


“কলেজে ভর্তির ফর্মে সবার উপরে মানবধর্ম”

ধর্মের নাম মানবতা। পড়ুয়াদের ভর্তির ফর্মে এ বার চাইলে এমনটাও লিখতে পারেন কোনও আবেদনকারী। এ বছর ভর্তির জন্য অনলাইনে ফর্মে পড়ুয়াদের জন্য এই সুযোগ করে দিচ্ছে কলকাতার বেথুন কলেজ এবং মেদিনীপুর কলেজ।

গত সোমবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে সেই রাত থেকেই অনলাইনে বিভিন্ন কলেজের ফর্ম পূরণ শুরু হয়েছে। আর সেখানেই বেথুন ও মেদিনীপুর কলেজের জন্য ফর্ম ভর্তি করতে গিয়ে আবেদনকারী ছাত্রীরা দেখতে পাচ্ছেন, ধর্মের কলামে তালিকার প্রথমেই রয়েছে মানবধর্ম। হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্ট বা অন্য যে কোনও ধর্মকে বাদ দিয়ে মানবতাকে নিজের ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করার সুযোগ পাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা।

কেন এই উদ্যোগ? বেথুন কলেজের অধ্যক্ষা মমতা রায় জানাচ্ছেন, গত বছরও কলেজে ভর্তির অনলাইন ফর্ম থাকলেও তাতে মানবতাকে নিজের ধর্ম বলে বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। তিনি বলেন, “অনেক আবেদনকারী হয়তো কোনও ধর্মেই বিশ্বাস করেন না। তিনি হয়তো শুধু মানবধর্মে বিশ্বাসী। এই আবেদনকারীরা ওই কলামে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান-সহ নানা ধর্মের মধ্যে ‘অন্যান্য’ বলে যেখানে উল্লেখ থাকত তা বেছে নিতেন। অনেকে আবার লিখে দিতেন ‘নন বিলিভার’। এবার থেকে তাঁরা নিজের মত আরও স্পষ্ট করে প্রকাশ করতে পারবেন।” অধ্যক্ষার মতে, মানবতা ছাড়া যে কোনও ধর্মই হয় না, সেই বার্তাও এর মাধ্যমে নবীন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে। আর মেদিনীপুর কলেজের অধ্যক্ষ গোপালচন্দ্র বেরা বলছেন, ‘‘মানুষের প্রথম পরিচয় সে মানুষ। মানবতাই তার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয়। তাই কলামটি এমন রাখা হয়েছে।’’


বেথুনের অধ্যক্ষা অবশ্য জানাচ্ছেন, সুষ্ঠু ভাবে ভর্তির মেধা-তালিকা বার করাটাই তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। তবে তার মধ্যেই ছোট ছোট বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই এ বার অনলাইনে ভর্তির আবেদনপত্র প্রকাশের আগে কলেজে অ্যাডমিশন কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, এ বারের আবেদনপত্রে ধর্মের তালিকায় স্থান পাবে মানবধর্ম।

বেথুন ও মেদিনীপুর কলেজ কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন আবেদনকারী ছাত্রী থেকে শুরু করে তাঁদের অভিভাবকদের অনেকেই। তাঁদের একাংশের মতে, এর ফলে অনেকেই নিজের মত প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন।


তবে শুধু কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রেই নয়। চাকরির আবেদন থেকে শুরু করে নানা জায়গায় ফর্ম ভর্তি করার সময়ে ধর্মের নাম লেখার একটি জায়গা থাকে, যা আবেদনকারীকে লিখতেই হয়। সেখানে বিভিন্ন ধর্মের নামের সঙ্গে সঙ্গে ‘অন্যান্য’ বলেও লেখা থাকে। বেথুন কলেজের মতো এ বার সেই সব জায়গায় ধর্মের কলামে মানবতাকে রাখা যেতেই পারে বলে মনে করছেন অনেকে।


সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মনে করছেন, সব ধর্মেরই মূল কথা মানবতা। এখন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে অনেক সময়ে বিভেদ সৃষ্টি হয়। আসলে ধর্মে ধর্মে কিন্তু কোনও বিভেদ নেই। শীর্ষেন্দুবাবুর কথায়, “আজকাল অনেকেই ধর্মীয় পরিচয় দিতে চান না বা দিতে লজ্জা পান। সে ক্ষেত্রে মানবতাকে বেছে নেওয়ার এই সুযোগ থাকাটা ভাল। তাতে আবেদনকারীকে একটা স্বাধীনতাও দেওয়া হল।” সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “এই উদ্যোগ অনুসরণযোগ্য।”

https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/bethune-college-and-midnapore-college-included-humanities-in-their-religion-section-1.999637


জন্মসূত্রে পাওয়া প্রতিষ্ঠানিক ধর্মপরিচয় ছেড়ে (যেমন- হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্টান ইত্যাদি) নিজেকে মানবতাবাদী বা Humanist ঘোষণা করতে চাইলে সেই ব্যক্তিকে এফিডেফিট (Affidavit) করাতে হবে নোটারী দ্বারা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষর সহ পাকাপোক্ত একটি এফিডেফিট এর জন্য যাতে ভবিষ্যতে কোনোরকম সমস্যা না এসে দাঁড়ায় (In order to have that, a Religion Change affidavit has to be prepared mandatorily. The affidavit is a legal document that contains details like name, the new religion, old religion, and address. It must be made on stamp paper and notarized by a notary public.) আমি, সন্তোষ শর্মা একজন সাংবাদিক এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সংযুক্ত সম্পাদক এবং ভারতের মানবতাবাদী সমিতির সদস্য, গত ৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ –এ ব্যারাকপুর নোটারী থেকে এস দত্ত মারফৎ ১৬ জন মুক্তচিন্তকদের সাথে এফিডেফিট করিয়ে Religion কলামে Humanism লেখার আইনত অধিকার লাভ করেছি। এফিডেফিট এর বয়ানটি তুলে ধরলাম -

"We, members of Humanist Association feel and sincerely believe that the greatest religion of Man is 'Humanism' which is most suitable for the protection and achievement of human rights and for the fullest expression of human talents. We therefore declare 'Humanism' as our religion. This is in accordance to the declaration of the General Assembly of UNO, November, 1981.

The religion of 'Humanism' is a way of life separate and different from any other like Hinduism, Islam, Christianity, Judaism etc. 'Humanism' has its separate organization and separate philosophy aiming at the total well-being of mankind where coercion and repression hardly exist."

ভারতে কোনো শিশুর জন্মনেওয়ার পরে পৌরসভা থেকে যে জন্মসংশাপত্র বা Birth certificate প্রদান করা হয় তাতে (form 5) কিন্তু Religion column বলে কিছু নেই, ব্যতিক্রমী কিছু যায়গা ছাড়া। অনেকেই অভিন্ন দেওয়ান বিধি অর্থাৎ Uniform Civil Code চালু করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবী জানাচ্ছেন। কিন্তু যতদিন না Uniform Civil Code তৈরি হচ্ছে, আইনের চোখে আবার ধর্ম থাকাটা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে Criminal Law আবার ধর্মের ধার ধারে না কিন্তু Personal Law (যেমন- Property, Marriage, Divorce, Inheritance ইত্যাদি) লাগু করতে হলে আমাদের দেশে এখনও ধর্ম ছাড়া গতি নেই। এমনকি কেউ যদি বিশেষ বিবাহ আইন বা Special Marriage Act এ বিয়ে করেও থাকেন, সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে গোলমাল বাধলে তার নিষ্পত্তি কোনও না কোনও ধর্মের Personal Law অনুযায়ী হবে। তবে, উইকিপিডিয়ার একটি তথ্য জানাচ্ছে-


Q: What is all about religion change in India?

Ans: As per Article 15 of the Indian Constitution, freedom of religion is one of the fundamental rights in India. India is a secular country and every Indian citizen has the right to practice and promote their own religion peacefully. This means changing religion (due to self-belief, marriage, or divorce) is legal in India provided the same is in good faith and not because of any coercion or application of force. অন্যদিকে, জনৈক দুর্গাদাস বাবু জানিয়েছেন – “আমার মেয়ের বয়স এখন 22, ওর Birth certificate এ কোনো পদবী বা টাইটেল নেই, এবং ধর্ম হিসাবে Humanism লিখেছিলাম। প্রথমে একটু ঝামেলা করলেও দমদম মিউনিসিপ্যালিটি থেকে Birth certificate বের করতে পেরেছিলাম। ধর্ম এবং পদবী ছাড়াই আমার মেয়ের সমস্ত রকম কার্ড, পাসপোর্ট, PAN, Aadhar, Driving license, Ration card, Voter card আছে।”


 


প্রিয় পাঠকবন্ধু, আপনি কি স্নেহা পার্থিবরাজকে চেনেন? উনি তামিলনাড়ুর তিরুপাত্তুর-এর বাসিন্দা এবং পেশায় আইনজীবি। কিছুসময় আগে তিনি একটি ব্যতিক্রমী কাণ্ড বা নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়েছেন তাও আবার ভারতের মতো ধর্ম ও বর্ণে শতবিভক্ত একটি দেশে। তিনিই ভারতের সেই প্রথম মহিলা যাঁর কোনো ধর্ম নেই এবং বর্ণও নেই (No Religion, No casts) এই স্বীকৃতি তিনি আদায় করেছেন দীর্ঘ লড়াইয়ের পর খোদ তামিলনাড়ু সরকারের কাছ থেকে। স্কুল জীবন থেকেই তিনি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাগজ পত্তরে ধর্ম ও বর্ণের যায়গাটি ফাঁকা রাখতেন। ২০১০ সাল নাগাদ তিনি এর জন্যে আইনি লড়াই শুরু করেন। পাশে পেয়ে যান তাঁর জীবনসঙ্গী পার্থিবরাজকেও। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মিলছে স্বীকৃতি। স্বয়ং তামিলনাড়ু সরকার, স্নেহা পার্থিবরাজকে সনদ পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন, এবার থেকে স্নেহা নিজেকে ধর্মহীন এবং বর্ণহীন মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে। সরকার একই সঙ্গে জানিয়ে দেয়, এখন থেকে স্নেহার একমাত্র পরিচয়,তিনি ভারতীয়।

স্নেহা পেরেছেন। কিন্তু বাকিরা? আরে মশাই আর কতদিন? আর কতদিন জন্মসূত্রে পাওয়া প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম কে আঁকড়ে ধরে বাঁচবেন? যুক্তিহীন ধর্মীয় বিশ্বাস ছেড়ে বের হয়ে আসুন। আনন্দ পাবেন। এমন এক অনাবিল আনন্দ যা টাকাপয়সা দিয়ে কেনা যায়না। অন্তত আগামীপ্রজন্মর স্বার্থেই এগিয়ে আসুন। গর্ব করে প্রচার করুন হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান ইত্যাদি নয়, মানুষের একমাত্র ধর্ম হচ্ছে “HUMANISM”।

স্নেহা পার্থিবরাজ। আপনাকে কুর্নিশ। লেখাটি শেষ করবো একটি অন্যরকম খবর জানিয়ে।


“চাকরির নথিতে ‘নাস্তিক’ লেখার দাবি, শিক্ষা দফতরে চিঠি শিক্ষিকার তা-ও যদি না-হয়, তবে ফর্মে ধর্মের জায়গা পূরণ ‘ঐচ্ছিক’ করতে হবে।”

পদবি ওঁর কাছে ‘ধর্মচিহ্ন’ ছাড়া আর কিছু নয়। তাই মেয়ের নামের সঙ্গে পদবি জোড়েননি দক্ষিণ ২৪ পরগনার উস্তির শেরপুর রামচন্দ্রপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শর্মিলা ঘোষ। এ বার তিনি শিক্ষা দফতরে চিঠি পাঠিয়ে তিনি দাবি করেছেন, চাকরি সংক্রান্ত সমস্ত নথিতে ধর্মের জায়গায় ‘নো রিলিজিয়ন’ বা ‘না-ধার্মিক’ লেখার সুযোগ তাঁকে দিতে হবে। একান্তই তা সম্ভব না-হলে, ফর্মের ওই জায়গায় ‘নাস্তিক’ অথবা ‘মানবিকতা’ লেখার সংস্থান থাকতে হবে নথিতে। আর তা-ও যদি না-হয়, তবে ফর্মে ধর্মের জায়গা পূরণ ‘ঐচ্ছিক’ করতে হবে।

শর্মিলা বলেন, ‘‘এখন চাকরি সংক্রান্ত সমস্ত নথি এবং ফর্মে ধর্মের জায়গায় আমাকে হিন্দু অথবা ‘আদার্স’ লিখতে হয়। এই ‘আদার্স’-এর অর্থও কোনও না কোনও ধর্ম। কিন্তু আমি কোনও ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ নই। তাই ফর্মের ওই জায়গায় আমাকে না-ধার্মিক, মানবিকতা অথবা নাস্তিক লেখার সুযোগ দিতে হবে। তা সম্ভব না হলে, ধর্মের জায়গা পূরণ করার বিষয়টি ঐচ্ছিক করতে হবে।’’ সঙ্গে যোগ করেন: ‘‘বছরের পরে বছর ধরে ওই ফর্মগুলিতে ধর্মের জায়গায় আমাকে হিন্দু অথবা আদার্স লিখে যেতে হচ্ছে। অথচ আমি প্রাতিষ্ঠানিক কোনও ধর্মপালন করি না। আমি আপাদমস্তক নাস্তিক এবং না-ধার্মিক।”

শর্মিলা ওই মর্মে চিঠি পাঠিয়েছেন শিক্ষা দফতরের কমিশনার, দফতরের সচিব, এবং জেলা স্কুল পরিদর্শককে। চিঠি পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং নিজের স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিউদ্দিন আহমেদকে। ঘটনাচক্রে রফিউদ্দিন আবার শর্মিলার স্বামী। রফিউদ্দিন বলেন, ‘‘উনি ধর্মাচরণ করেন না। আমিও করি না। ওঁর বক্তব্যের সঙ্গে সহমত। শিক্ষা দফতরে একই আবেদন আমিও জানাব বলে ভাবছি।’’জেলা স্কুল পরিদর্শক প্রদ্যোৎ সরকারের বক্তব্য, ‘‘আমি ওই শিক্ষিকার আবেদনপত্র ই-মেল মারফত পেয়েছি। কিন্তু এই বিষয়টি আমার এক্তিয়ারে পড়ে না। তাই আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। এটি রাজ্য সরকারের বিষয়। যদি কিছু করার থাকে, রাজ্য সরকার বা শিক্ষা দফতর করতে পারে।’’

শর্মিলা বলেন, ‘‘বেতন-সহ নানা বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনলাইনে ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে হয়। ফর্ম ছাড়াও শিক্ষা দফতরের পোর্টালেও চাকরি সংক্রান্ত অনেক বিষয় পাঠাতে হয়। সর্বত্রই ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে ধর্মের জায়গাটি পূরণ করতে হয়। অথচ আমি বাড়িতে বা অন্য কোথাও ধর্মাচরণ করি না। ধর্মীয় কোনও রীতিও মানি না। সেই কারণেই আমি ওই দাবির কথা জানিয়েছি দফতরকে।’’


নামের পাশে পদবির উল্লেখ নিয়েও তাঁর অবস্থান পরিষ্কার। শর্মিলার সংযোজন: ‘‘কেউ মানুক বা না-মানুক, এটা বাস্তব যে, পদবি দেখে মানুষের ধর্ম চেনা যায়। পদবিকে তাই আমি ধর্মচিহ্ন বলেই মনে করি। এই কারণে আমি মেয়ের নামের পাশে কোনও পদবির উল্লেখ করিনি।’’ শর্মিলার মেয়ের নাম ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’। স্কুল-সহ সব নথিতে এটাই তার নাম।

খবরটির লিংক- https://www.anandabazar.com/west-bengal/24-parganas/woman-wrote-letter-to-education-department-to-permit-her-to-write-atheist-on-religion-coloumn-1.1193102

তথ্যসহায়তায়: সুমিত্রা পদ্মনাভন (প্রাক্তন সভাপতি, ভারতের মানবতাবাদী সমিতি) সদ্যপ্রয়াত আইনজীবী শ্রী গীতানাথ গাঙ্গুলী এবং নোটারী অফিসার দেবদুলাল সাহা।

মন্ত্রপূত লটারির টিকিট -
সন্তোষ শর্মা
Nov. 18, 2024 | অলৌকিক | views:113 | likes:2 | share: 2 | comments:0

লটারি! অনেকে লটারির টিকিট কেটে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। মাঝে-মঝেই খবর আসে অমুক ব্যাক্তি লটারিতে কোটি টাকা পেয়েছে। এই খবরে উৎসাহিত হয়ে আরও বেশি বেশি করে লোক লটারির টিকিট কেটে নিজের রক্ত জল করে উপার্জিত টাকা পয়সা ধ্বংস করতে থাকেন। এখানেই শেষ নয়, অনেকে আবার কোনও জ্যোতিষ বা  তান্ত্রিকের খপ্পড়ে পড়ে মন্ত্রপূত লটারির টিকিট কেটে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেনে। আমার মেজ মামা নির্মলের ছেলে রাজীব কোটিপতি হওয়ার জন্য এক তান্ত্রিকের খপ্পড়ে পড়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকা গাচ্ছা দেয়। শেষে প্রতারণার শিকার হয়ে মামাত ভাই রাজীব ঐ তান্ত্রিকের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করে দেওয়ার জন্য আমরা হাত-পা ধরে। প্রতারক তান্ত্রিকের কাছ থেকে ভাইয়ের টাকা উদ্ধার করতে গিয়ে সে কি ভয়ংকর বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম , তা এখানে লিখছি।

রাতে আমার পত্রিকা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি মেজ মামা নির্মল, মামি এবং তাঁদের ছেলে রাজীব এসেছে। মামারা আমার মা মিথলেশ দেবীর সঙ্গে গল্প করতে মশগুল। এই মামাকে দেখেই মনের কোণে সন্দেহ দেখা দিলে, “আবার কোনও নতুন ফন্দি নিয়ে মামা, মামি ও ভাই এসেছে। এর আগেও যখনই মামার বাড়িতে পা রেখেছে, তখনই আমাদের কোনও ক্ষতি হয়েছে।  এই কারণেই আমি মামার বাড়ির কাউকে এক চোখেও দেখতে চাই না।”

আমাকে নিজের ঘরে ঢুকতেই মামা নির্মল বলে উঠলেন, “আমার সবথেকে প্রিয় ভাগ্না সন্তোষ। পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করছে। শুনেছি ভাগ্না নাকি এখন ভূত-প্রেত, জ্যোতিষ, ওঝা- তান্ত্রিক, বাবাজীদেরকে জব্দ করে।”

মামার মুখে এমন কথা শুনে একটু আবাক হলাম। আমি ওঝা- তান্ত্রিককে জব্দ করি, এই কথা কি করে জানল? ওহ ! আমার ফেরার আসেই মায়ের সঙ্গে গল্পের ছলে আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিয়েছে। একবার কি মামা কোনও ওঝা বা তান্ত্রিকের খপ্পড়ে পড়েছে? এবং উদ্ধারের জন্য আমার কাছে ঘ্যান-ঘ্যান করবে?”

মামি মুখ ভার করে বললেন, “তোমার ভাই রাজীব খুব বোকা। এক তান্ত্রিকের চক্করে পড়ে বাড়িতে জমানো ২৫ হাজার টাকা খুইয়ে এসেছে। তুমি দেখো না, ঐ তান্ত্রিকের কাছ থেকে টাকাগুলি উদ্ধার করে দিয়ে পারো কি না।”

শুনেই আমার মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। রেগে গিয়ে মামিকে মুখের উপর বলে ফেললাম, “রাজীব যখন অমুক তান্ত্রিককে কি কারণে অতো টাকা দিয়ে গিয়েছিল তা আমি জানি না। তান্ত্রিককে টাকা দেওয়ার আগে কি ভাই আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল কি? এখন কেন আমাকে টাকা উদ্ধার করে দেওয়ার জন্য বলছ।

আমার হাত ধের মাম বললেন, “অমন করে রাগ করো না।  তুমি আমাদের সব থেকে প্রিয় ভাগ্না। বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি। দেখো কিছু করতে পারো কি না?”

“আমি এই সবের মধ্যে নেই। যদি টাকা উদ্ধার করতে চাও তাহলে তোমার ঐ তান্ত্রিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করো।”আমি বললাম।

মামি বললেন, “আমার মুখ্য-সুখ্য মানুষ। এক অক্ষর লেখাপড়া করিনি। পুলিশের নাম শুনলেই ভয় করে। থানায় অভিযোগ করতে জানলে কি শিক্ষিত ভাগ্নের কাছে ছুটে আসতাম?”


বললাম, “যাই বল।  ভাই যে বকামি করেছে, তার ভাগিদার আমি কেন হব?”

ভাই রাজীব বললেন, “সন্তোষ দা, আমি বুঝতে পারিনি। ভুল করেছি। এবার তো সাহায্য করবে না?”

ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “ঠিক আছে। বল কি হয়েছিল? কেন তুই তান্ত্রিককে এতো টাকা দিতে গেলি?”

রাজীব জানল, “আমি কোটিপতি হওয়ার জন্য অনেক টাকার লাটারির টিকিট কেটেছি। কিন্তু  লাটারিতে এক টাকাও জিততে পারিনি। এক দিন বাহাদুর নামে একজন লোকের সঙ্গে বান্ধুত হল। সে  তোমার বাবার সঙ্গে ঘুরে-বেড়ায়। তাঁর বয়স প্রায় ৩৫ –এর কাছাকাছি।”

আমি লটারি কেটে কোটিপতি হতে চাই। এই কথা জানারা পর বাহাদুর বললে, “ধুর বোকা। ঐ ভেবে টিকিট কাটলে কেউ কোটিপতি হয় না। আমি এমন একজন তান্ত্রিক বাবাজীকে জানি তিনি তোর কপাল পাল্টে দিতে পারনে। তাঁর কাছে যেই গেছে,ল লাভবান হয়েছে। তুইও চল। ফল হাতেনাতে পাবি।”

বাহাদুরের কথা বিশ্বাস করে ওঁর হাত ধরে এক তান্ত্রিকের বাবাজীর কাছে গেছিলাম। আমার কথা শুনে বাবাজী বলল, “লটারির টিকিট কেটে কোটিপতি হওয়া মুখের কথা নয়। এটা কপালের ব্যাপার।  তোর কপালেই কোটিপতি লেখা আছে। কিন্তু পাথে বিশাল বাঁধা। সেটাকে পার করতে পাড়লেই কেল্লাফতে। তুই কি লাখপতি-কোটিপতি হতে চাস? “

মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ, বাবাজী। আমি অনেক টাকা চাই।”

“তুই যদি লটারি কেটে কোটিপতি হতে চাস তাহলে তোর নামে একটা যজ্ঞ করে করতে হবে। যজ্ঞে একটি লটারির নাম্বার উঠবে। সেই নাম্বারেই কোটি টাকা উঠে আসবে।”

বোকার মত জিগ্যেস করলাম, “মানে যজ্ঞ করে নাম্বার উঠবে এবং তাতেই কোটিপতি হয়ে যাবো?”

“হ্যাঁ রে টাকার লোভী। হাত বাড়ালেই কি টাকা পাওয়া নারে বোকা। এর জন্য অনেক সাধনা করতে হয়।”বাবাজী বললেন।

বাবাদুর বোঝাল, “দেখ রাজীব। তুই এতদিন লাটারির টিকিট কেটে কেটে অনেক টাকা পয়সা নষ্ট করেছি। বাবাজী যখন বলছেন, তাহলে আর একটু টাকা খরচা করতে আসুবিধে তো নেই। তাই বলছি, বাবাজীর যা বলছেন মন দিয়ে শোন। যখন কোটি টাকা পাবি তখন এই বাহাদুর কাকার কথা মনে পড়বে না।”

তান্ত্রিকের কথা শুনে দিনের বেলায় চোখের সামনে টাকার বান্ডিল দেখতে লাগলাম। ভাবছি সত্যি যদি লাটারির টিকিট কেটে কোটি টাকা জিততে পারি তাহলে একটা চার চাকার গাড়ি কিনবো।

তান্ত্রিক বললেন, “কিরে খোকা কি ভাবতে শুরু করেছিস। তোর সব স্বপ্ন পূর্ণ হবে রে।”

“বাবাজী বলুন, আমাকে কি করতে হবে?”আমি জিগ্যেস করলাম।

তান্ত্রিক বললেন, “একটি যজ্ঞ করতে হবে। এর জন্য ২৫ হাজার টাকা লাগবে। পারবি কি এতো টাকা দিতে?”

মাথা চুলকিয়ে বললাম, “বাবাজী এতো টাকা এখন কোথা থেকে পাবো?”

“দেখ এটা তোর ব্যাপার। তুই যদি পারিস তাহলেই যজ্ঞ করা সম্ভব। তুই যখন আমার চ্যালা বাহাদুরের সঙ্গে এসেছিস। তাই তোকে একসঙ্গে ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে না। তুই এখন শুধু যজ্ঞের সামগ্রি এবং আগিম ৫ হাজার টাকা দে। তার পার বাকি কাজের জন্য টাকা দিবি। এবার বল?”বাবাজী বললেন।

“ভালো উপায় কথা বলেছেন বাবাজী। দেখ রাজীব আমার জন্য তোকে অনেক ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ভেবে দেখ এখন কি করবি? বাহাদুর বললেন।

বাহাদুরের উপর বিশ্বাস করে আমি তান্ত্রিককে যজ্ঞের সামগ্রী এবং অগ্রিম ৫ হাজার টাকা দিলাম।

এক অমবস্যার রাতে বাহাদুরে সঙ্গে ঐ তান্ত্রিকের আশ্রমে গেলাম। তান্ত্রিক যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞ বেদী থেকে ছাইভস্ম তুলে আমার কপালে ঘষে দিলেন। এবং তান্ত্রিক বললেন, “আসছে পূর্ণিমাতে তুই লটারির এক বান্ডিল টিকিট কিনবি। তার মধ্যেই একটি টিকিটে কোটি টাকার পুরষ্কার উঠবে।”

তান্ত্রিকের কথামত আমি পাড়ার ফুটপাতের দোকান থেকে কয়েকশো টাকার লটারির টিকিট কিনে আনলাম। আনন্দে দিশেহারা। উফ আর কিছু দিন। লটারি খেলার ফল বেরোলেই কোটি টাকা পাবো।


দুদিন পর।

আমার সব টাকা মাটি হয়ে গেল। লটারি খেলার ফল প্রাকশিত হল। কিন্তু আমি এক টাকাও পেলাম না। সব টিকিট বেকার হয়ে গেল। আমি নিরশ হয়ে বাহাদুর কাকার কাছে ছুটে গেলাম। সব কথা বলে কাকা বলল, “চল তান্ত্রিকের কাছে।”

সব শুনে তান্ত্রিক বললেন, “আমার যজ্ঞ বিফলে যায় না। মনে হচ্ছে তুই আমার কথা মতো কাজ করিস নি। তুমি অবশ্যই কোনও ভুল করেছিস। আরে খোকা এটা তো প্রথম ধাপ। একবারেই কি ফল পাওয়া যায়রে।”

বললাম, “আপনার কথা মত সব টিকিট কেটেছি।”

“পূর্ণিমার সকালে লটারির টিকিট কাটতে যাওয়ার আগে কি তুই স্নান করে, মন্দিরে পূজা দিয়েছিলিস?”বাবাজী জিগ্যেস করেন।

মাথা নেড়ে বললাম, “না বাবাজী।”

“লটারির টিকিট কাটার সময় তুই অসুদ্ধ ছিলিশ। তাহলে তুই বল। আমরা যজ্ঞ কি করে ফল দেবে?”বাবাজী বললেন।

আমি জিজ্ঞেস কারলাম, “তাহলে কি আমার টাকা জলে গেলো?”

“না না। তোমার ছোট্ট ভুলের জন্য লটারির টিকিট কিনে টাকা হল। কিন্তু একটা উপায় আছে।”তান্ত্রিক বললেন।

“কি উপায় বাবাজী? আমি জিগ্যেস করলাম

তান্ত্রিক বললেন, “নতুন করে যজ্ঞ করতে হবে।”

“এর জন্য কি আবার টাকা দিতে হবে?”আমি জিগ্যেস করলাম।

“হ্যাঁ, না দিয়ে যজ্ঞ কি করে করবো। বিনা পয়সায় কিছু হয় না খোকা। এবার যজ্ঞ করার পর তুমাকে কোটিপতি হওয়ার থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। কিন্তু এবার পুরো ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। যদি ফল না পাও তাহলে টাকা ফেরত করে দেবো।”তান্ত্রিক বললেন।

আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। এতো টাকা একসাথে কোথা থেকে পাবো।

বাবাজী জিগ্যেস করলেন, “এতো কিসের চিন্তা করছিস। তুই যখন লটারিতে কোটি টাকা পাবি, তখন সব চিন্তা ছুমন্তর হয়ে যাবে।”

বাবাজীর কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তো কথায় নেই। এই ভেবে বললাম, “ঠিক আছে বাবাজী। আমি টাকা দিতে রাজি আছি।”

“বাহ। খোকা একটু সাবধান। টাকা আনর্থের কারণ। তাই আবার ভালো করে চিন্তা করে বলো। যজ্ঞের জন্য এতো টাকা দিতে পারবে তো?”তান্ত্রিক বললেন।

আমি জিগ্যেস , “বলুন যজ্ঞের জন্য কবে টাকা দিয়ে হবে?”

“যেদিন দিবি, সেদিনই যজ্ঞ হবে।”তান্ত্রিক হেঁসে বললেন।

এক সপ্তাহের পর ২০ হাজার টাকা নিয়ে বাহাদুর কাকার সঙ্গে আবার ঐ তান্ত্রিক বাবাজীর আশ্রমে গেলাম। লটারির টিকিটে কোটি টাকা পাবো, এর জন্য তান্ত্রিক অনেক ক্ষণ ধরে যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞ বেদী থেকে এক মুঠো ছাই নিয়ে আমার কপালে ঘষে দিয়ে তান্ত্রিক বললেন, “মন দিয়ে শোন। আসছে অমাবস্যার দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠে চান করে। বাড়ির কাছে মন্দিরে পূজা দিবি। মায়ের কাছে মানত করবি, লটারিতে কোটি টাকা পেলে দু’জোড়া পাঠা বলি দেবো। আমি আগেও বলেছি, আমার যজ্ঞ বিফল যায় না। খেয়াল থাকে, এবার জেন কোনও ভুল না হয়। যা এবার। জয় মা কালী।”

তান্ত্রিকের কথা শুনে মনে হল এবার আমার নামে লটারি ফাসবেই। তাই তান্ত্রিকের কথা মত অমাবস্যার দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠে চান করি। শ্যামনগর কালী মন্দিরে মায়ের  পূজা করি। সেখান থেকে বেড়িয়ে আবার সেই ফুটপাতের ঝুপড়ি মার্কা দোকান থেকে এবার বেশি সংখ্যক লটারির টিকিট কিনলাম। টিকিটের বান্ডিলগুলি মাথায় ঠেকিয়ে মা কালীর উদ্দ্যেশে মনে-মনে বললাম, “দে মা আমাকে কোটিপতি করে দে। আমার আমি তোর পুজাতে দু’জোড়া পাঠা দেবো।”


চারদিন পর।

কাগজে লটারির ফল প্রকাশ হল। কিন্তু একি ! আমার কাটা লটারির একটিও নাম্বারে এক টাকাও পেলাম না। এই দেখে আমি মনমরা হয়ে গেলাম। কোটিপতি হওয়ার জন্য ঐ তান্ত্রিকের পেছনে ২৫ হাজার থেকেও বেশি টাকা খরচ করে ফেলেছি। তবুও এক টাকাও পেলাম না। তান্ত্রিক বলেছিল, “যদি ফল না পাও তাহলে টাকা ফেরত করে দেবো।”এই কথা মনে পড়তেই ছুটে গেলাম বাহাদুর কাকার বাড়িতে। কাকাকে বললাম, “তান্ত্রিকের কথা বিফলে গেছে। আমার টাকা ফেরত চাই।”

“টাকা? কিসের টাকা?”অবাক হয়ে বাহাদুর বললেন। 

“ঐ যে তান্ত্রিক যা কাছে তুমি আমাকে নিয়ে গেছিলে। আমার থেকে ২৫ হাজার টাকা নিয়ে  লটারির জন্য যজ্ঞ করেছিল। কিন্তু লটারিতে এক টাকাও পেলাম না। সব টাকা জলে গেল। কোনও  লাভ হয়নি। এখন আমার টাকা ফেরত চাই।”বললাম।

বাহাদুর বলল, “তুই কি আমাকে টাকা দিয়েছিলিস। যাকে টাকা দিয়েছেস তার কাছে যা।”

“তুমিও তো আমাকে ঐ তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে গেছিলে। তোমার কথা শুনেই আমি ঐ তান্ত্রিককে টাকা দিয়েছি। এবার ঐ তান্ত্রিকের কাছে থেকে আমার টাকা আদায় করে দাও তুমি।”

বাহাদুর বললেন, “তুই লটারিরে কোটি টাকা পাবি বলে তান্ত্রিককে যজ্ঞের জন্য টাকা দিয়েছিল। তুই তান্ত্রিককে যে টাকা দিয়েছিলি  সেই টাকা যজ্ঞে স্বাহ হয়ে গেছে। তাই ঐ টাকা ফেরত হয় না।”

“তান্ত্রিক বলেছিল, যদি ফল না পাই তাহলে টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। আমাকে ঐ তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে চল। আমি টাকা আদায় করে নেবো।”আমি বললাম।

এই শুনেই বাহাদুর ধমকের সুরে বললেন, “টাকা ফেরত পাওয়া এতো সোজা নয়। যজ্ঞে টাকা খরচ হয়ে গেলে। দেখ। সকাল সকাল ভ্যাট বকিস না। ভাগ এখান থেকে। আমার অনেক কাজ আছে।”

“এরপর আমি নিজে ঐ তান্ত্রিকের আশ্রম স্থলে ছুটে গেলাম। কিন্তু ওখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। বুঝতে পারলাম। লটারিরে কোটি টাকা পাওয়ার লোভে পড়ে ঐ বাহাদুরের কথায় বিশ্বাস করে এক তান্ত্রিকের খপ্পড়ে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়েছি। শেষ পর্যন্ত যুক্তিবাদী কাজ কর্মের কথা শুনে তোমার কাছে ছুটে এসেছি সন্তোষ দা। তুমিই বল একবার আমি কি করবো?”এই বলে রাজীব কেঁদে উঠল।


আমি বললাম, “তোদের মত লোভী মানুষই তান্ত্রিকের মতো প্রতারকের মেন  টার্গেট। এই সুযোগ নিয়ে তান্ত্রিকেরা বাহাদুরের মত চ্যালা পুষে রাখে। এই চ্যালারাই বলির পাঠা নিয়ে গিয়ে তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে যায়। এবং নিজের মত করে জবাই করে।”

“এই বাহাদুর কাকাকে ধরে টাকা আদায় করা যায় না?”ভাই বলল।

আমি বললাম, “ঐ তান্ত্রিকের কাছে যদি কোনও ধরণের অলৌকিক ক্ষমতা থাকত তাহলে সে নিজেই যজ্ঞ করে লাটার টিকিট কেটে কেন কোটিপতি হতে পারছে না? আসলে এই প্রতারক তান্ত্রিকরা ভালো করেই জানে অলৌকিক ক্ষমাটা বলে কিছু হয় না। যাজ্ঞ যজ্ঞ ইত্যাদি লোক ঠকানো ফন্দি মাত্র। আর এই বাহাদুরও একটা চিটিংবাজ। এক চক্করে তুই কি করে পড়লি?”

“বাহাদুর কাকা আমার পিসের সঙ্গে বাড়িতে প্রায় দিন আসত। সেই সূত্রে ওনার সঙ্গে পরিচয়।”রাজীব বলল।

আমি বললাম, “ঠিক আছে। দেখছি তান্ত্রিকের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যায় কি না। কিন্তু তার জন্য বাহাদুরের সঙ্গে কথা বলি।”


কয়েক দিন পর।

বাবার সঙ্গে বাহাদুর আমার বাড়িতে এলো। সামনে পেয়ে তাঁকে বললেন, “আমার একটি সমস্যা আছে। ভাবছি কোনও তান্ত্রিকের কাছে যাবো। তোমার সঙ্গে কোনও তান্ত্রিকের যোগাযোগ আছে কি?”

আমার কথা শুনেই ভূত দেখার মত করে বলল, “তুমি তো যুক্তিবাদী। এই সব তান্ত্রিক – ওঝাতে বিশ্বাস করো না। তাহলে আবার তান্ত্রিকের কি দারকার?”

“তুমি তো রাজীবকে এক তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে গেছিলে না? তার কাছে আমাকেও নিয়ে চলো।”আমি বললাম।

আমার কথা শুনেই বাহাদূরের বুঝতে অসুবিধা হল না রাজীবের সব কথা আমি জেনে ফেলছি। এবং এবার সে বড় সামস্যায় পড়তে চলেছে। বড়বড় চোখ করে বাহাদুর বলল, “ও এবার বুঝেছি কেন তুমি তান্ত্রিকের কাছে যেতে চাইছ।”

বললাম, “রাজীব লটারির টিকিট কিনে কোটিপতি হতে চায়। এই লোভে পড়ে সে তোমার চক্করে পড়ে এক তান্ত্রিকের কাছে গাঁটের ২৫ হাজার টাকা গেঁড়িয়ে এসেছে। কিন্তু ঐ তান্ত্রিক বলেছে, কাজ না হলে টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়ে হবে। তাই বলছি আমাকে ঐ তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে চলো। আমি টাকা আদায় করে নেবো।”

“তুমি কি বলতে চাইছো, রাজীবের টাকা আমি নিয়েছি?”বাহাদুর বলল।

আমি বললাম, “তুমি যদি রাজীবকে বুঝিয়ে বলতে লটারির টিকিট কাটিস না। তুমি যদি ভাইবে ঐ তান্ত্রিকের কাছে না নিয়ে যেতে তাহলে ও এভাবে এতো টাকা তান্ত্রিক, যজ্ঞের পেছেন খরচ করত না। সোজা কথায় তুমি ঐ তান্ত্রিকের চ্যালে হিসবে কাজ করে ভাইকে ঠকিয়েছ। তাই বলছি, হয় ভালো মানুষের মত ভাইয়ের টাকাগুলি ফেরত দিয়ে দাও। নাহলে তান্ত্রিক এবং তোমার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করবো।”

“দেখছি কি করা যায়।”এই বলে বাহাদুর বাড়ি বেড়িয়ে গেলো।

রাতে পত্রিকা অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই দেখি  মা বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই মা বললেন, “তুই ভালো আছিস তো। তোর কিছু হয়নি তো?”

“আমি ভালো আছি। হটাৎ এই কথা কেন জিজ্ঞেস করছ?”আমি বললাম।

বড় বোন বাসন্তি বললেন, “সাকালে বাহাদুর দা কে তুমি বলেছিলে যদি তান্ত্রিক টাকা ফেরত না দাও তাহলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করবে। বিকেলে রাগে গজগজ করতে করতে বাহাদুর দা বাড়ির এসেছিল। তোমার নাম করে আমাকের হুমকি দিয়ে গেছে। বলেছে, তুমি যদি ওঁর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে নালিশ করো তাহলে তোমাকে এই জগৎ থেকে গায়েব করে দেবে।”

মা বললেন, “বাহদুর এও বলেছে, তাঁর এক ভাগ্নে এখন জেলে বন্ধ আছে। ও একটি খুন করার অভিযোগে জেলে বন্ধ আছে। কিছুদিন পর ভাগ্নে জেল থেকে ছাড়া পাবে। তখন ভাগ্নে কে বলে তোকে  খুন করে দেবে। তুই রাতে যখন অফিস থেকে ট্রেনে করে ব্যারকপুর স্টেশনে নামবি। তখনই তোকে গুলি করে মেরে ফেলবে।”

বাহ বাহ। এখন বুঝতে পারছি ও বাবার হাত আমার ও মামার বাড়িতে আসা যাওয়া করছে। ভাইয়ের টাকা লুট করছে। এখন টাকা চাইতেই সে নিজের আসল রং দেখাছে। পুলিশের নাম শুনেই বাড়িতে এসে হুমকি দিচ্ছে। দাড়াও বাহাদুর তোমার সব বাহাদুরির শায়েস্তা করছি।

মাকে আশ্বস্ত করে বললেন, “এবার বুঝতে পাড়লে তো মেজো মামা বাড়িতে এসে আমাদের সামস্যার মধ্যে ফেলে গেলো। এই জন্যই আমি এনাদের এড়িয়ে চলি। চিন্তার কোনও কারণ নেই। বাহাদুর আমার সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। ও আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু এবার ওঁকে শায়েস্তা করতেই হবে।”

পরের দিন দুপুরে অফিস যাওয়ার আগে বাহাদুরের বাড়িতে হাজরি হলাম। আমাকে দেখেই বাহাদুর চমকে উঠল। বললাম, “কাল বিকেলে তুমি আমার বাড়িতে গিয়ে কি বলে এসেছ? তুমি আমাকে খুন করবে? আমি মারা গেলে তোমার কপালে ভোগান্তি আছে বুঝলে। বাড়িতে গিয়ে খুনের হুমকি দেওয়ার আগে ভেবেছ কি তুমি ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে। তুমি আমার মাকে আমাকে খুন করার জন্য যে হুমিক দিয়ে এসেছ তাঁর জন্য তোমার বিরুদ্ধে এক্ষণই থানায় অভিযোগ করে পুলিশের হাতে গ্রেফতার করিয়ে দেবো।”

কথার মাঝেই বাহাদুরের বউ আমরা হাতজোড় করে বললেন, “সন্তোষ এঁকে ক্ষমা করে দাও। এ কোনও কাজ করে না। আমার স্বামী জেলে গেলে আমরা বাচ্চা দুটির কি হবে।”

বললাম, “তোমার স্বামী রাজীবের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছে, সেটা ফিরিয়ে দিতে বল। না হলে সত্যিই পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করবো।”

“আমি তোমাকে সহজ সরল ছেলে ভাবতাম। কিন্তু তুমি যে এতো চালাক চতুর বুঝতে পারিনি। তোমাকে চিনতে ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দাও। চেষ্টা করে দেখছি ঐ তান্ত্রিকের কাছ থেকে টাকা ফেরত পাওয়া যায় কি না।”বাহাদুর বলল।

এক মাস পর।

রাজীব এসে বললে, “সন্তোষ দা তোমার জন্য ঐ তান্ত্রিকের কাছ থেকে টাকা ফেরত পেয়েছি।”

আমি বললাম, “এবার থেকে আর কোনও ওঝা, তান্ত্রিক, জ্যোতিষী, বাবাজী, মাতাজী-এর মতন বুজরুকদের চক্করে পরিস না। কারণ, এঁরা প্রত্যেকেই প্রতারক।”

বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন -
সন্তোষ শর্মা
Nov. 16, 2024 | জ্যোতিষ | views:843 | likes:49 | share: 17 | comments:0

ভারতীয় আইনে জ্যোতিষ-শাস্ত্রের বা তন্ত্র-শাস্ত্রের কোনও স্বীকৃতি নেই। জ্যোতিষী বা তান্ত্রিক কোনও আইন স্বীকৃত পেশা নয়। এমনকি, জ্যোতিষ-শাস্ত্রের বা তন্ত্র-শাস্ত্রের চর্চা ও প্রচার ‘দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস অ্যাক্ট, ১৯৫৪’- অনুযায়ী নিষিদ্ধ। অর্থাৎ অ্যাক্ট ১৯৫৪ অনুযায়ী, জ্যোতিষ বা তন্ত্রমন্ত্র চর্চা ও প্রচার করা বেআইনি। এছাড়া ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্যাক্স অন প্রফেশন,  ট্রেড, কলিং অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭৯ অনুযায়ী জ্যোতিষ বা তান্ত্রিক পেশা স্মাগলার এবং খুন করা পেশার মতই বেআইনি, তাই সরকারী অডিটোরিয়াম বা প্রেক্ষাগৃহে বেআইনি এই পেশাদারদের সম্মেলন করতে দেওয়াটাও বেআইনি। দেশের যে কোনও স্থানে জ্যোতিষীদের বা তান্ত্রিকদের সম্মেলনের আয়োজন করাও বেআইনি। কিন্তু আজও  জ্যোতিষী- তান্ত্রিকের লোকঠকানো বে-আইনী ও বুজরুকির ব্যবসা আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলছে। জ্যোতিষী- তান্ত্রিকের এই প্রতারক চক্র আবার সম্মেলনের আয়োজন করছে। এর পরেও ধান্ধাবাজ, প্রতারক এই জ্যোতিষী- তান্ত্রিকদের মনের মধ্যে একটি ভয় সব সময় লেগে থাকেই। সেই ভয়ের নাম ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’। কারণ, এই যুক্তিবাদী সমিতি’র জন্য প্রতারক জ্যোতিষীদের ও তান্ত্রিকদের রাতের ঘুম উড়ে গেছে। তাই এঁরা কোথাও সম্মেলন করার আগেও গ্রহ-রত্ন, তাবিচ, কবচ, মন্ত্রতন্ত্র ইত্যাদিতে বিশ্বাস হারিয়ে পুলিশের উপর ভরসা রাখেন। আজ এমনই একটি ঘটনা লিখছি।   

সোমবার ১৩ জানুয়ারী ২০২০ 

পুরুলিয়া জেলা থেকে প্রতি সোমবার ও  বৃস্পতিবার প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘পুরুলিয়া দর্পণ’ –এ জ্যোতিষীদের সম্মেলনের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। ১৩ জানুয়ারী প্রকাশিত ‘পুরুলিয়া দর্পণ’ থেকে আমরা জানতে পারি একটি জ্যোতিষ সংগঠনের ডাকে পুরুলিয়ার নিস্তারিণী মহিলা কলেজ -এ  জ্যোতিষ সম্মেলন হতে চলেছে। বিজ্ঞাপনটি এখানে তুলে ধরছি।

  অনুষ্ঠানের স্থান পরিবর্তন

 রবীন্দ্রকাডেমির অ্যানুয়াল ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অ্যান্ড কনভোকেসন-২০২০ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আগামী ১৮ই জানুয়ারী ( শনিবার) নিস্তারিণী কলেজের অডিটোরিয়ামে। 

দেশ বিদেশের খ্যাতনামা জ্যোতিষী, বাস্তুবিদ, তান্ত্রিক, সাধু ও মহাপুরুষগণের উপস্থিতিতে এক বিরল অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে চলেছে পুরুলিয়া। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য প্রবেশপত্র  সংগ্রহ করুন।

 যোগাযোগ

 সাউথ কোলকাতা অ্যাসট্রলজি অ্যান্ড বাস্তু সায়েন্স একাডেমি

 পুরুলিয়া শাখা

জ্যোতিষ সম্মেলনের এই বিজ্ঞাপন দেখার পরেই আমরা ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ থেকে সিদ্ধান্ত নিই এই সম্মেলনের বিরুদ্ধে  পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার। কারণ, যে জ্যোতিষ বা তান্ত্রিক পেশার কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। সেই বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের বা তান্ত্রিকদের এবং তাঁদের সংগঠনের সম্মেলনও এক কথায় বেআইনি। তাই পুরুলিয়ার নিস্তারিণী মহিলা কলেজ-এ  জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধ করার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে আমরা যুক্তিবাদীরা অবশ্যই দাবি জানাব। 

 বৃহস্পতিবার ১৬ জানুয়ারি ২০২০

১৩ জানুয়ারীর ‘পুরুলিয়া দর্পণ’–এ প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত জ্যোতিষ ও বাস্তুশাস্ত্রের সম্নেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ১৮ই জানুয়ারী নিস্তারিণী কলেজের অডিটোরিয়ামে। তাই যুক্তিবাদী সমিতি সিদ্ধান্ত নেয়, এই বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার। কেন এই অভিযোগ ? এর উত্তরে শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর, ২০০২-এ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর তুলে ধরছি।

   আনন্দবাজার পত্রিকা

 ২০ ডিসেম্বর, ২০০২

পেশাই নয় জ্যোতিষ, বৃত্তিকর দিতে গিয়ে জানলেন জ্যোতিষী

 অভিজিৎ ঘোষাল

 আইন মানা নাগরিক হিসাবে বৃত্তিকর দিতে গিয়ে তিনি জানলেন, জ্যোতিষচর্চা এই রাজ্যে পেশা হিসাবেই গণ্য নয়। হতবাক তিনি। কারণ, দেশের মানবসম্পদমন্ত্রী মাত্র কিছুদিন জ্যোতিশাস্ত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের আওতায় এনেছেন। অথচ তাঁর কর দেওয়ার আবেদন নাচক করে বৃত্তিকর দফতর বলেছে, জ্যোতিষশাস্ত্রকে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই চর্চা দেশের আইন পরিপন্থী। ওই  ‘অপরাধ’-এর জন্য জেল ও জরিমানা দুই-ই হতে পারে।

দেশে মনুবাদের ক্রমশ জোরালো হাওয়া উপেক্ষা করে বৃত্তিকর আধিকারিক অশোককুমার দাস-এর নজিরবিহীন নির্দেশে যা বলা হয়েছে, তা বস্তুত জ্যোতিষচর্চা নিয়ে বিতর্কে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। অশোক বাবু লিখেছেন,  বৃত্তিকর দেওয়ার আবেদন অনুমোদনের সময় সেটা সংশ্লিষ্ট সমাজে স্বীকৃত আইনসিদ্ধ কিনা সেটা প্রথম ও প্রধান বিবেচ্য।

 তাঁর মতে এই পরীক্ষাতেই জ্যোতিষশাস্ত্র ডাহা ফেল।

 তাঁর নির্দেশে অশোকবাবু লিখেছেন, ভারতীয় আইনে জ্যোতিষশাস্ত্রের কোন স্বীকৃতি নেই। এমনকি, এর চর্চা ও প্রচার ১৯৫৪ সালের ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস অ্যাক্ট অনুযায়ী নিষিদ্ধ। ফলে কনসালটেন্ট বা উপদেষ্টা হিসাবে আবেদন করলেও তাঁর পেশা আইনত গ্রাহ্য নয় - বলে ওই জ্যোতিষীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন অশোক বাবু।

 যার বিরুদ্ধে এই রায়, বালিগঞ্জের সেই জ্যোতিষী মণিশংকর দাশগুপ্ত মুখ খুলে বিতর্কে ইন্ধন যোগাতে নারাজ। তাঁর সাফ কথা, কর দিতে ইচ্ছুক নাগরিকের কাছ থেকে দেউলিয়া সরকার যদি কর নিতে না -চায়, তাহলে তাঁর কিছু বলার নেই। তবে যে-বৃত্তি তাঁকে আয়কর দিতে বাধা দেয় না,  সেই বৃত্তিকে পেশার মর্যাদা দিতে রাজ্য সরকারের বাধা কোথায়? নির্দেশ হাতে পাওয়ার কয়েক সপ্তাহের পরেও সেটা তাঁর মাথায় ঢুকছে না। তবে তিনি স্বীকার করেছেন জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত উত্তর কলকাতা অ্যাস্ট্রলজিক্যাল রিসার্চ প্রজেক্টের যে-সার্টিফিকেট তিনি বৃত্তিকর দফতরে পেশ করেছিলেন, তার আইনি স্বীকৃতি নেই বলে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন অশোকবাবু। মণিশংকরবাবুর বক্তব্য, তাঁদের পেশায় ‘লাইসেন্সসিয়েট সার্টিফিকেট’- এর প্রচলন নেই।

যে পেশার ওপর বহু শিক্ষিত মানুষের আস্থা আছে, সেই জ্যোতিষচর্চাকে কেন তিনি এভাবে নস্যাৎ করলেন ? গোটা বিষয়টি নিয়ে অশোকবাবু মুখে কুলুপ  আঁটলেও তাঁর নির্দেশেই পরিষ্কার তাঁর যুক্তি। ১৯৫৪ সালের ওই আইনে দেশের সর্বোচ্চ আইনসভার অর্থাৎ সংসদ এই পেশাকে এইভাবে বর্ণনা করেছে, পেশাটি অনৈতিক, অবাঞ্চিত, বেআইনি, মানুষের সুস্বাস্থ্যের ক্ষতিকারক ও মনুষ্য সভ্যতার পক্ষে হানিকারক।

 বছর পয়তাল্লিশের মণিশংকরবাবু ১০-১১ বছর ধরে মানুষের ভাগ্যগণনাকেই তাঁর জীবিকা করেছেন। মণিশংকরবাবু জানিয়েছেন, কোনও অলঙ্কার বা গ্রহরত্নের দোকানে বসে জ্যোতিষচর্চা করেন না তিনি। ফলে ভাগ্যগণনা ছাড়া অন্য কোনও স্বার্থ নেই তাঁর। কলকাতায় তো বটেই, দিল্লিতেও তাঁর বেশ ভাল পসার। বিদেশেও তাঁর কিছু গুণমুগ্ধ আছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে দু’দিন টানা দেড় ঘণ্টা ধরে জ্যোতিষশাস্ত্র কী ও কেন, বৃত্তিকর আধিকারিকদের সেটা বোঝাতে যে ব্যর্থ হয়েছেন, তা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। 

 এই খবর থেকে দিনের আলোর মত এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, যে জ্যোতিষ পেশার কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। এই বেআইনি পেশায় বৃত্তিকর নেওয়া হয় না। বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের বা তাঁদের সংগঠনের সম্মেলনও এক কথায় বেআইনি। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কী করে একটি জ্যোতিষ সংগঠনকে নিস্তারিণী মহিলা কলেজের অডিটোরিয়ামকে জ্যোতিষ সম্মেলন করার জন্য ভাড়া দেওয়া হল ? বেআইনী এই জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবিতে যুক্তিবাদী সমিতি’র পুরুলিয়ার জেলা সম্পাদক মধুসূদন মাহাত, জেলা শাসক ও কলেজের প্রিন্সিপালকে চিঠি লেখেন। সেই চিঠি পাঠকের সামনে তুলে ধরছি।

 




প্রতিলিপি  

প্রিন্সিপাল                                                                                    নিস্তারিণী মহিলা কলেজ

বিষয়ঃ জ্যোতিষ বুজরুকদের সম্মেলন বন্ধ করার দাবি।

 

 মহাশয়া,

 আমরা অর্থাৎ ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সদস্যরা সংবাদপত্র ‘পুরুলিয়া দর্পণ’  ( তারিখ - ১৩ জানুয়ারী, ২০২০ ) থেকে জানতে পারি যে, আপনার কলেজের অডিটোরিয়ামে জ্যোতিষীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৮ জানুয়ারী, ২০২০, শনিবার।  তাই আপনার অবগতির জন্য জানাই যে, দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস ( অবজেকসনেবল এডভারটাইজমেন্ট ) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ আইন অনুযায়ী, জ্যোতিষ শাস্ত্রের চর্চা ও প্রচার করা বেআইনি। এছাড়া ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্যাক্স অন প্রফেশন,  ট্রেড, কলিং অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭৯ অনুযায়ী ‘জ্যোতিষ’ পেশা হিসেবে গণ্য নয়, যেমন পেশাই নয় ‘খুন করা’ বা  ‘স্মাগলিং’। এছাড়া জ্যোতিষ শিক্ষার কোন বিধিবদ্ধ স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানও ভারতে নেই। জ্যোতিষ একটি অবিজ্ঞান বা বুজরুকি। তাই সরকারী অডিটোরিয়ামে বেআইনি পেশাদার বা বুজরুকদের সম্মেলন করতে দেওয়াটাও বেআইনি।

তাই আপনার প্রতি আমাদের তথা ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ পুরুলিয়া জেলা শাখার সদস্যদের অনুরোধ দয়া করে জ্যোতিষের মত বেআইনি, নিষিদ্ধ, অবাঞ্ছিত, অনৈতিক এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক পেশাদার বা চর্চাকারীদের সম্মেলনের জন্য সরকারী অডিটোরিয়াম ভাড়া বাতিল করে বাধিত করবেন।

 

 

 

বিনীত

 মধুসূদন মাহাত,

 সম্পাদক

 পুরুলিয়া জেলা শাখা

 ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি 

 প্রতিলিপি –

 ১) জেলাশাসক, পুরুলিয়া

 মধুসূদন মাহাত এই চিঠিটি আমাকেও ওয়াটসঅ্যাপে পাঠানোর পর ফোন করে বললেন, “ সরকারী কলেজের অডিটরিয়ামে জ্যোতিষী নামক বুজরুকদের সম্মেলন বন্ধ করার দাবি জানিয়ে ঐ কলেজে আমরা গিয়েছিলাম। কিন্তু ঐদিন কলেজ বন্ধ থাকায় অভিযোগপত্র জমা দেওয়া যায়নি। কাল সকালে আবার যাবো। ” আমি বললাম, “ ঠিক আছে। নিস্তারিণী মহিলা কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি জানানোর পর প্রিন্সিপালের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলে আমাকে জানাও। আমি এই খবরটি মিডিয়াতে প্রকাশিত করার চেষ্টা করবো। ”

শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

 আজ আবার মধুসূদন মাহাত ও যুক্তিবাদী সমিতি’র উপদেষ্টা জয়ন্ত দাস ঐ সরকারী কলেজে যান। এদিন কলেজ খোলা থাকলেও প্রিন্সিপাল ডঃ ইন্দ্রানী দেবকে কলেজ পাওয়া যায়নি। এরপর কলেজ থেকেই ফোন নং নিয়ে প্রিন্সিপালকে ফোনে ধরেন জয়ন্তবাবু। জয়ন্তবাবু বলেন, “ আপনার একটি চিঠি রয়েছে। কিন্তু রিসিভ করার কেউই নেই। একটু ফোন করে বলে দিন যেন চিঠিটা রিসিভ করে নিক। ”  এরপর প্রিন্সিপাল বলে দেওয়াতে চিঠিটা একজন রিসিভ করেন। 

এরপর যুক্তিবাদী সমিতি’র তরফ থেকে মধুসূদন নিজে কলেজের প্রিন্সিপালকে ফোন করে প্রশ্ন করলেন, “ যেখানে জ্যোতিষ পেশা বেআইনি, সেখানে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত জ্যোতিষীদের সরকারি কলেজের কলেজের অডিটোরিয়াম কী করে ভাড়া দেওয়া হল?  যুক্তিবাদী সমিতি’র তরফ থেকে ওই অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি জানানো হচ্ছে। চিঠিতে আমরা জানিয়েছি, যেহেতু দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিজ ( অবজেকসনেবল এডভারটাইজমেন্ট ) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ অনুসারে জ্যোতিষ চর্চা ও প্রচার করা বেআইনি। এছাড়া ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোফেসন এন্ড ট্যাক্স অনুযায়ী জ্যোতিষ পেশা স্মাগলার এবং খুন করা পেশার মতই বেআইনি, তাই সরকারী অডিটোরিয়াম বা প্রেক্ষাগৃহে বেআইনি পেশাদারদের সম্মেলন করতে দেওয়াটা বেআইনি। জ্যোতিষীদের সম্মেলন করতে দিলে আগামী দিনে হয়তো পতিতা, স্মাগলার, খুনিরাও সরকারী অডিটোরিয়াম ভাড়া নেবে। ”

 এই শুনে প্রিন্সিপাল জানালেন, “ জ্যোতিষ পেশা বেআইনি নয়। জ্যোতিষ পেশা বেআইনি হলে জ্যোতিষীরা চেম্বার খুলে বসে থাকতে পারতেন না। যদি জ্যোতিষ চর্চা বেআইনি হয়, তাহলে জ্যোতিষীদের পুলিশে ধরত। যদি জ্যোতিষ পেশা বেআইনি হয়, তবে জ্যোতিষীদের এত রমরমা হত না। ” এদিকে তিনি নিজেকে জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরোধী ব্যক্তি ও নিজেকে একজন বিজ্ঞান মঞ্চের সক্রিয়কর্মী দাবি করেন।

 বাহ কেয়া বাত! 

 এদিকে নিস্তারিণী মহিলা কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি করে যুক্তিবাদী সমিতি কলেজের প্রিন্সিপাল ও জেলাশাসককে পাঠানো চিঠির উপর ভিত্তি করে দৈনিক ‘একদিন’ পত্রিকার সাংবাদিক কৃশানু দে’কে দিলাম। এদিকে যুক্তিবাদী সমিতি’র চিঠির প্রতিলিপি সোশাল মিডিয়া ও ফেসবুকে পোস্ট করে দেওয়ায়, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়।

  শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২০

 সকালে স্মার্ট ফোনের ইন্টারনেট অন করে আজ প্রকাশিত ‘একদিন’-এর ই-পেপারে সরকারি কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি নিয়ে খবরটি পড়ছিলাম। খবরটি হল --

 

 একদিন

 ১৮ জানুয়ারি ২০২০

 জ্যোতিষচর্চায় কলেজে বিতর্ক 

 নিজস্ব প্রতিনিধি ঃ পুরুলিয়ার এক মহিলা কলেজের প্রেক্ষাগৃহে জ্যোতিষ চর্চার আয়োজন করা নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এই অভিযোগে শুক্রবার কলেজ কর্তিপক্ষকে লিখিত অভিযোগ জানাল ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র পুরুলিয়া জেলা শাখা। আজ অর্থাৎ ওই প্রেক্ষাগৃহে জ্যোতিষ চর্চার অনুষ্ঠান হওয়ার কথা রয়েছে। সমিতি প্রশ্ন তুলেছে, কলেজের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিভাবে জ্যোতিষ চর্চার মতো বেআইনি অনুষ্ঠান  হতে পারে। সংগঠনের জেলা সম্পাদক মধুসূদন মাহাত-র তরফে লিখিত এই আবেদন কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে, ‘ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস অবজেকসনেবল অ্যাডভারটাইজমেন্ট আইন ১৯৫৪’ অনুয়ায়ী জ্যোতিষ শাস্ত্র চর্চা এবং প্রচার করা বেআইনি।  

একটু পরে পুরুলিয়া থেকে মধুসূদন ফোন করে বললেন, “ সরকারি কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি করে আমার লেখা চিঠির কথা জ্যোতিষীদের কানে পৌঁছে গেছে। সম্মেলন শুরু করার আগেই জ্যোতিষীরা আতঙ্কিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের চিন্তার কারণ, আমরা যুক্তিবাদীরা ওই জ্যোতিষ সম্মেলনে হাঙ্গামা করতে পারি। যুক্তিবাদী সমিতি’র নেতার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লণ্ডভণ্ড করে না দেয়। এই ভয়ে জ্যোতিষীদের সংগঠক সম্ভবত পুরুলিয়ার মফঃস্বল থানার ওসি সঞ্জয়কুমার চক্রবর্তীর স্মরণাপন্ন হয়েছেন। এরপরই পুরুলিয়ার মফঃস্বল থানার ওসি তাঁর সিভিক ভল্যান্টিয়ারের মাধ্যমে সকাল ১১ টার সময় জ্যোতিষ বিষয়ে আলোচনা এবং আমার সঙ্গে পরিচয় করার তাগিদে থানায় ডেকে পাঠিয়েছে। ”

 

 মধুসূদনের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। হেসে বললাম, “ জ্যোতিষীদের একি দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা। যে জ্যোতিষী তাঁর গ্রাহকের যে কোনও সমস্যার সমাধান করতে গ্রহ-রত্ন, পাথর, তাবিজ, কবজ, মাদুলি ইত্যাদি দিয়ে থাকে। আর যখন যুক্তিবাদী সমিতি’র সংকট ঘাড়ে চেপে ধরে তখন আবার এই জ্যোতিষীরাই গ্রহ-রত্ন,পাথর, তাবিজ, কবজ ইত্যাদির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে পুলিশের সাহায্য চায়! যুক্তিবাদী সমিতি’কে আটকাতে শেষ পর্যন্ত পুলিশের সাহায্য! হায় রে প্রতারক জ্যোতিষীরা। এই জনই আমার যুক্তিবাদীরা বুক ঠুকে বলে থাকি, “ যে যত বড় জ্যোতিষী সে ততো বড় প্রতারক। ”

 

মধুসূদন বললেন, “জ্যোতিষীরা কেউ-ই জ্যোতিষ শাস্ত্রে তিল-মাত্র বিশ্বাস করে না। জ্যোতিষীরা তাঁদের জীবনের কোন সমস্যার সমাধানের জন্য গ্রহ-রত্ন ধারণ করে না। অসুখ হলে ডাক্তার দেখায়।  মামলা হলে উকিল রাখেন। এমনকি ভাগ্যের উপর নির্ভর না করে খদ্দের ধরতে পত্র- পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু লোক ঠকানোর জন্য বুজরুকি রূপ ধারণ করে থাকা এই জ্যোতিষীরা হাতের আঙ্গুলগুলিতে, গলায় গ্রহ-রত্ন, তাবিচ, কবচ ইত্যাদি ধারণ করে থাকেন। কিন্তু এইসব হিজিবিজি জিনিসে এই জ্যোতিষীদের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। ”

 আমি বললাম, “জ্যোতিষ সম্মেলন নিয়ে আলোচনা করার জন্য যখন থানার ওসি ডেকে পাঠিয়েছেন, তোমরা অবশই যাও। এটা আমাদের কাছে একটা সুবর্ণ সুযোগ। পুলিকেও এটা  বোঝানো যাবে, যে জ্যোতিষ পেশার কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। এই বেআইনি পেশায় বৃত্তিকর নেওয়া হয় না। বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের বা তাঁদের সংগঠনের সম্মেলনও এক কথায় বেআইনি। পুলিশের সঙ্গে দেখা করার পর আমাকে সবকিছু জানাবে। ”

 এদিকে আমার দুষ্টুবুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ১৩ জানুয়ারী ‘পুরুলিয়া দর্পণ’-এ প্রকাশিত বিজ্ঞাপন থেকে জানতে পারি একটি জ্যোতিষ সংগঠনের ডাকে আজ পুরুলিয়ার নিস্তারিনী মহিলা কলেজে জ্যোতিষ সম্মেলন হতে চলেছে। তাই একটু খুঁচিয়ে দেখার জন্য ওই বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত মোবাইল নম্বরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সংগঠনের সভাপতি অভিজ্ঞান আচার্যকে ফোন করলাম। আমি প্রশ্ন করলাম, “ ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র তরফ থেকে আপনাদের বেআইনি সম্মেলন বন্ধ করার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। সমিতি’র জেলা সম্পাদক মধুসূদন মাহাত-র দাবি, ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস (অবজেকসনেবল এডভারটাইজমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ আইন অনুযায়ী জ্যোতিষ শাস্ত্রের চর্চা ও প্রচার করা বে-আইনি। এরপরেও জ্যোতিষ সম্মেলন কি করে আয়োজিত হচ্ছে ? ”

 আমার প্রশ্ন শেষ হবার আগেই আচার্যজী রেগে অগ্নিশর্মা।  “ জ্যোতিষ বেআইনি নয়। যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে আমাদের সম্মেলন বন্ধ করে দেখাক ওঁরা ? ” এই বলে উনি ফোন কেটে দিলেন।

 

প্রায় দু’ঘণ্টা পরে মধুসূদন আবার আমাকে ফোন করে বললেন, “ আমি ও জয়ন্তদা থানায় গিয়েছিলাম। ওসি জ্যোতিষ নিয়ে আলোচনা করেন। ওসি কোনও সময়  জ্যোতিষের পক্ষে, কোনও সময় বিপক্ষে কথা বলেন। এরপর তিনি আমাদের কাছে জানতে চান ওই জ্যোতিষ সম্মলনে আমাদের যুক্তিবাদী সমিতি’র কোনও বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে কি না ? আমরা জানাই, আমাদের কোন বিক্ষোভ কর্মসূচি নেই, ব্যাপারটা আমরা প্রশাসনের মধ্য দিয়েই করতে চাই। এরপরেই দেখলাম ওসি জ্যোতিষ সম্মেলনের আয়োজকদের ফোন করে আশ্বস্ত করলেন, তাঁদের ভয়ের কিছু নেই, যুক্তিবাদীরা হাঙ্গামা করবে না। এর ফলে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল জ্যোতিষীরা যুক্তিবাদী সমিতি’কে ভয় করেছিল। তাই ভাগ্য, কুষ্ঠি, গ্রহ-রত্ন,আংটি, মাদুলির ইত্যাদির উপর বিশ্বাস হারিয়ে, শেষ পর্যন্ত পুলিশের উপর ভরসা রেখেছিল। জেলাশাসক ওসিকে তদন্ত করতে বলেছেন, এই দাবিটা ওসি  আসলে মিথ্যা বলেছিলেন। আসল সত্যিটা হল, জ্যোতিষীরা সম্ভবত টাকার বিনিময়ে ওসিকে বশে এনেছিলেন নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতেই।”

 আমি বললাম, “ ভাবতে অবাক লাগছে, বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের সরকারি সভাগারে সম্মেলন বন্ধ করার পরিবর্তে পুলিশ যুক্তিবাদীদের থানায় ডেকে পাঠাচ্ছে। একই সঙ্গে শুধু মাত্র টাকার বিনিময়ে এক প্রিন্সিপাল জ্যোতিষকে আইনি বলে দাবি করেছে। এঁরা কোন শিক্ষায় শিক্ষিত, তার জবাব সময় দেবে। কিন্তু জ্যোতিষীদের বেআইনি সম্মেলন বন্ধ করার জন্য আমরা যুক্তিবাদীরা যে বিশাল কাজ করেছি, তা নতুন প্রজন্মের কাছে একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।”

সন্তোষ শর্মা

সংযুক্ত সম্পাদক

 ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি

 ‌ব্যারাকপুর, কলকাতা - ১২২

 মোবাইল : ৯৩৩০৪৫১৯৭৭

চলো যাই ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র বাড়ি -
সন্তোষ শর্মা
Nov. 9, 2024 | ভান্ডাফোঁড় | views:913 | likes:63 | share: 53 | comments:0

যে কোন ধরণের ভাঙ্গা হাড় জুড়ে দেওয়ার দৈব-চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মছলন্দপুরে ঘোষপুরের চারাবটতলা। শ্রীমতী লক্ষ্মী মণ্ডলের নাম ঐ অঞ্চলে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’ নামে প্রসিদ্ধ। ইনি যে কোন ভাঙ্গা হাড় শুধুমাত্র দৈব-চিকিৎসার মাধ্যমে জুড়ে দিয়ে থাকনে। এই খবর কানে আসার পর আমরা ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ-এর নেতৃতে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র দৈব-চিকিৎসার বুজরুকি ফাঁস করার জন্য একটি প্ল্যান তৈরি করলাম।  


শনিবার ২৮ অক্টোবর ২০০৬

সকালে আমাকে নিজের বাঁ হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধতে দেখে ছোট বোন শান্তি জিজ্ঞেস করল, “সন্তোষদা হাতে কি হয়েছে? ব্যান্ডেজ বাঁধছো কেন?”

বললাম, “হাতে ছোট লেগেছে। ব্যাথা করছে। ডাক্তারের কাছে যাবো বলে ব্যান্ডেজ বাঁধছি। ”

একটু পরে প্রবীর বাবু ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, “যেভাবে বলেছিলাম, সেইভাবে হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধেছ? চুলদাড়ি কাটনি তো?”

আমি বললাম,  “আপনার প্ল্যান মাফিক কাজ করছি। ”

তিনি বললেন, “শোন, কলকাতার মানিকতলা থেকে শংকর ভড়ও তোমার সঙ্গে যাবে। কিন্তু তোমার দু’জনে আলাদ-আলাদভাবে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র বাড়িতে যাবে। এমনভাবে থাকেব, দেখে মনে হবে, তোমরা একে-অপরকে চেন না। ঠিক করে যাবে। যদি কোনও ধরণের বিপদ হলে সঙ্গে-সঙ্গে আমাকে ফোনে খবর দেবে। ”

বাঁ হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে, একটি মোটা সুতোর সঙ্গে হাত গলায় ঝুলিয়ে নিলাম। এই অবস্থায় আমি বাড়ির কাছের বাসস্টপ কুন্ডুবাড়ি থেকে বাসে ধরে প্রথমে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসাত রেল স্টেশনে পৌছালাম। সেখান থেকে বনগাঁও লোকাল ট্রেন ধরে মছলন্দপুর স্টেশনে নামলাম। স্টেশনের বাইরে বেড়িয়ে দেখি ভ্যান চালকেরা হাঁক পারছে, “কেউ কি ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র বাড়িতে যাবেন। ”

কয়েকজন একসাথে ভ্যানে উঠে পরলাম। সহযাত্রীদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, এঁরাও দৈব চিকিৎসার জন্য ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র কাছে যাচ্ছেন। 

প্রায় ১০ মিনিট পর ঘোষপুরের চারাবটতলায় অবস্থিত ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র কাছে নামলাম। ভাড়া নেওয়ার সময় ভ্যান চালক বললেন, “ বুড়ি’মার কাছে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার জন্য সরসে তেল ও কালো সুতো নিয়ে যাবেন। ”

বললাম, “আমি তো এই জিনিস তো আনিনি। তাহলে কি হবে?”

ভ্যান চালক বললেন, “চিন্তা করবেন না বাবু। ঐ যে ছোট্ট মুদির দোকান দেখতে পারছেন। ওখানেই তেল-সুত পাওয়া যায়। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। চার টাকা দিন আমি নিজেই কিনে এনে দিচ্ছি। ”


 

১০ টাকার একটি নোট বের করে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ফিরে এসে আমার হাতে একটা ছোট তেলের শিশি এবং একহাত লম্বা কালো সুতো দিলেন। 

মাটির কাঁচা রাস্তা দিয়ে কিছুদূর এগোতেই চোখে পড়ল একটি কুঁড়েঘর। বাড়ির সামনে উঠেন প্রায় ৫০০ লোকের ভিড়। কেউ বাঁ ভ্যানে করে, কেউ বাঁ কোলে চড়ে, কেউ লাঠিতে ভর করে এসেছেন। একজন যুবক এগিয়ে এসে বলল, “আপনি কি ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’ মার কাছে চিকিৎসার জন্য এসেছেন?”

বললাম, “হ্যাঁ, বাঁ হাতে সমস্যা। ”

 ‘সরিষা তেলের শিশি এনেছেন কি?’ সে জিজ্ঞেস করল। 

বললাম -হ্যাঁ, নিয়ে এসেছি। 

যুবকটি বলল, “ঐ যে তেলের শিশির লাইন দেখছেন। ঐ লাইনে আপনার শিশিটি রেখে দিন। আপনাকে কষ্ট করে লাইনে দাঁড়াতে  হবে না। ” 

একটু পরে শংকরদা এলেন। তিনিও সরিষা তেলের শিশি লাইনে রেখে এক কোনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেখি তাঁর ডান পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা। 

এদিকে সূর্য মাথার উপরে উঠে গেছে। রুগীদের ভিড় বেড়েই চলেছে। শিশির লাইন একটু-একটু করে বুড়ি’মার ঘরের দিকে এগোচ্ছে। প্রায় ঘন্টা খানেক পর আমার শিশি বুড়িমার সামনে পৌছাল। দেখলাম, প্রায় ৬০ বছর বয়স্ক এক মহিলা। তাঁর মাথায় সাড়ির আঁচাল দেওয়া। তাহলে ইনিই ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’। আসল নাম লক্ষ্মী মণ্ডল। কিন্তু ঐ অঞ্চলে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’ নামে প্রসিদ্ধ। ইনি হাড় ভাঙ্গার দৈব চিকিৎসা করে থাকেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বুড়ি’মার সামনে উবু হয়ে বসলাম। বুড়ি’মা জিজ্ঞেস করলেন, “কি সমস্যা?”

আমি বললাম, “সাইকেল থেকে পরে বাঁ হাতে চোট পেয়েছি। এক্স-রে করিয়ে দেখেছি, হাড়ে চির ধরেছে। প্রচন্ড ব্যাথা। লোকমুখে শুনেছি, আপনি দৈব ক্ষমতায় ভাঙ্গা হাড় জুড়ে দেন। তাই চিকিৎসার আশায় হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে এতদূরে ছুটে এলাম। ”

আমার বাঁ হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে বুড়ি’মা বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়লেন। হাতে তিন বার ফুঁ দিলেন। ছোট তেলের শিশির ঢাকনা খুলে তাতে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলেন। শিশি থেকে একটু তেল নিয়ে আমার বাঁ হাতে মালিশ করলেন। এরপর আমার গলায় একটা কালো সুতোয় একটা শিকড় বেঁধে পড়িয়ে দেন। এবং বাকি সুতটি একটি হেসুয়া দিয়ে কেটে দিলেন। 

আমরা হাতে তেলের শিশিটি দিয়ে বুড়ি’মা বললেন, “এটা মত্রপুত তেল। এই তেল দিয়ে মালিশ করবেন। গরম সেঁক দেবেন। ”

আমি বললাম, “হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা। ব্যাথার ওষুধ খাচ্ছি। এই তেল ও শেকড় দিয়ে আমরা হাত ঠিক হয়ে যাবে তো?”

বুড়ি’মা মাথা নাড়িয়ে বললেন, “আমার দৈব ওষুধ বিফলে যাবে না। এখন থেকে আর কোন ওষুধ খেতে হবে না। গলায় ঝলানো এই শিকড় সব ব্যাথা শুষে নেবে। চিন্তা করো না। ”


জিজ্ঞেস করলাম, “এই চিকিৎসার জন্য কত টাকা দিয়ে হবে। ”

“আমি এই দৈব চিকিৎসার পরিবর্তে এক টাকা নিই না। আপনার যদি ইচ্ছে হয় তাহলে মায়ের দানবাক্সে কিছু দান কারুন। ” বুড়িমা বললেন। 

একটি ১০ টাকার নোট দানবাক্সে ফেলে বেড়িয়ে এলাম। দৈব চিকিৎসক ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’মার বাড়িতে আজ প্রায় ৫০০ লোকের ভিড়। হিসেব করে দেখলাম, “আমার মত প্রত্যেকে যদি ১০ টাকা করে দেয়, তাহলে একদিনে বুড়ি’মার ৫০০০ টাকা আয় হবে! তাহলে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মিলিয়ে মাসে কত টাকা আয় হচ্ছে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’মা সেটা পাঠকরাই হিসেব করুন। ”

এরপর শিশির লাইনে মধ্যমে শংকরদা এগিয়ে গেলেন। 

বুড়ি’মা জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে?”

বামপায়ের পায়জামাটা একটু উপরে তুলে শংকরদা বললেন, “কাল রাতে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় পা পিছলে পড়ে যাই। এক্স-রে করিয়ে জানতে পারি হাড়ে চির ধরেছে। আমি পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে কোলকাতা থেকে আপনার কাছে দৌড়ে এসেছি মা। ”

বুড়ি’মা বললেন, “পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলুন। ”

বুড়ি’মা বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়লেন। তিন বার ফুঁ দিলেন। শিশির ঢাকনা খুলে তাতে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলেন। গলায় একটা কালো সুতোয় একটা শিকড় বেঁধে পড়িয়ে দিলেন। বাকি সুতাটি একটি হেসুয়া দিয়ে কেটে দিলেন। 

শংকরদা হাতে শিশিটি দিয়ে বুড়িমা বললেন, “এই মন্ত্র পড়া তেল দিনে পায়ে মালিশ করবেন। গরম সেঁক দেবেন। কোন ডাক্তারের ওষুধ খেতে হবে না। হাড়ের চির জুড়ে যাবে। ”

এখনে উপস্থিত প্রত্যেক রোগীকেই ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’মা একই পদ্ধতিতে অলৌকিক চিকিৎসা করে চলেছেন। 

এদিকে আমি ও শংকরদা ভ্যানে করে মছলন্দপুর স্টেশনে ফিরে এলাম। এখান থেকে সিয়ালদাহগামী ট্রেনে উঠে বসলাম। প্রায় দু’ঘণ্টা পরে শিয়ালদহতে নেমে দু’জনে পায়ে হেঁটে ৩৩এ ক্রিক রো, মৌলালি, কলকাতায় অবস্থিত যুক্তিবাদী সমিতি’র স্টাডি ক্লাসে পৌছালাম। 

এই স্টাডি ক্লাসে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন প্রবীর বাবু। তিনি আমার ও শংকরদার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, “আজকের আলোচনার বিষয় -চলো যাই ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র বাড়ি। 

আমি বললাম, “প্রবীর বাবুর নেতৃতে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র দৈব-চিকিৎসার বুজরুকি ফাঁস করার জন্য একটি প্ল্যান তৈরি করা হয়েছিল। তাই আমি ও শংকরদা দু’জনে নিজেকে হাড় ভাঙ্গা রোগী হিসাবে অলৌকিক চিকিৎসক ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়িমা’ অর্থাৎ  লক্ষ্মী মণ্ডলকে দেখাই। আমি বাঁ হাতে এবং শংকরদা বাঁ পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে বুড়ি’মার কাছে গিয়েছিলাম। মজার বিষয় হলে, বুড়ি’মা শুধুমাত্র হাতে বা পায়ে বাঁধা ব্যান্ডেজ খুলেই তাঁর ‘দিব্যদৃষ্টি’ দিয়ে দেখে নিচ্ছেন, হাড় ভেঙ্গেছে কি না। রুগীর হাড় জোড়া দিতে এই শিশির সরষে তেল ও গলায় এই শেকড় বেঁধে দিচ্ছেন। এখন থেকে আর ডাক্তারের ওষুধ খেতে হবে না। ”


 


শংকরদা বললেন, “প্রবীর বাবুর প্ল্যানমাফিক বাড়ি থেকেই আমি ও সন্তোষ দু’জনে পায়ে ও হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে গেছিলাম। আমাদের মুখের কথাতেই বুড়ি’মা ভাঙ্গা হাড় জোড়া দেওয়ার জন্য মন্ত্র পড়লেন, ফুঁ দিলেন। গলায় শিকড় বেঁধে দেলেন। আসলে ঐ বুড়ি’মার কাছে কোনও ‘দিব্যদৃষ্টি’ নেই। থাকলে বুঝতে পারতেন, আমাদের হাতে-পায়ের হাড়ে কোনও চির ধরেনি। পড়ে গিয়ে হাড়ে চিরটা একটি সাজানো গল্প। ”

আমাদের কাছে থেকে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র বিস্তারিত ঘটনা শুনে প্রবীর বাবু বললেন, “এই প্রতারক দৈব চিকিৎসকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে হবে। ”  


বৃহস্পতিবার ২ নভেম্বর ২০০৬

ভাবতে অবাক লাগে আজও আনেক মানুষ ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, তেলপড়া, শেকড়-বাকড়, দৈব ও অলৌকিক চিকিৎসায় বিশ্বাস করে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র মতন বুজরুকের কাছে প্রতারনার শিকার হচ্ছেন। এই সব বুজরুকদের মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্য আমরা যুক্তিবাদীরা সব সময় তৈরি আছি। এই বুজরুকদের শুধু মুখোশ খুলে দিলেই হবে না। চিকিৎসার নামে সাধারণ মানুষের জীবন নেই ছিনিমিনি খেলা এই বুজরুকের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানবার প্রয়োজন। 

ড্রাগ এন্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০ অনুসারে, দৈব উপায়ে যে কোন রোগের চিকিৎসা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আইন অনুসারে, ‘ড্রাগ লাইসেন্স’ ছাড়া যদি কেউ (‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র মত) তেলপড়া, ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, শিকড় ইত্যাদি দিয়ে ভাঙ্গা হাড় জুড়ে দেওয়া অথবা যে কোন রোগের দৈব চিকিৎসা করার দাবি করেন তাহলে তাঁর জেল ও জরিমানা দুই হবে। 

আজও এই রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে সঠিক চিকিৎসা পরিসেবা মেলে না। আর্থিক এবং অন্ধবিশ্বাসে ডুবে থেকে মানুষ দৈব চিকিৎসার চক্করে পড়ে নিজের জীবনে বিপদ ডেকে আনেন। অন্য দিকে, প্রকাশ্যে বুজরুকি ব্যবসা চল্লেও পুলিশ ও প্রশাসন উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। ফলে, বুজরুকি ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। এমন অবস্থায় দায়িত্ব বাড়ে আমরা যুক্তিবাদীদের। 

শেষ পর্যন্ত যুক্তিবাদী সমিতি’র নেতা শংকর ভড় একজন রুগী হিসাবে উঃ ২৪ পরগনা জেলার সুপারিটেডেন্ট অফ পুলিশ কাছে দৈব চিকিৎসক ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র অর্থাৎ শ্রীমতী লক্ষ্মী মণ্ডলের বিরুদ্ধে লিখতি অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগ পত্রটি এখানে তুলে দিলাম-


মাননীয়,                                                                            তারিখ–২. ১১. ২০০৬

সুপারিটেডেন্ট অফ পুলিশ                          

উঃ ২৪ পরগনা, বারাসাত


 


আমি শংকর ভড়,  ১১ বি ভড়লেন, কোলকাতা-৬ –এর বাসিন্দা। আমি গত ২৮/১০/২০০৬ তারিখে বেলা ১২ তা ১০ নাগাদ উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মছলন্দপুরে ঘোষপুর, চারাবটতলায় অবস্থিত শ্রীমতী লক্ষ্মী মণ্ডলের বাড়িতে যাই। শ্রীমতী লক্ষ্মী মণ্ডলের নাম ঐ অঞ্চলে হাড়ভাঙ্গা বুড়ি নামে প্রসিদ্ধ। ইনি হাড়ভাঙ্গার দৈব চিকিৎসক হিসাবে রোগীদের চিকিৎসার মাধ্যমে চিকিৎসা করে থাকেন। আমি যখন ঐ বাড়িতে প্রবেশ করি, তখন সেখানে আনুমানিক প্রায় ৫০০ (পাঁচশত) জন মত রোগী ও তাঁদের আত্মীয় স্বজনের ভিড় দেখতে পাই। 

আমি নিজেকে একজন হাড়ভাঙ্গা রোগী হিসাবে অলৌকিক চিকিৎসক লক্ষ্মী মণ্ডলকে দেখাই। তখন বেলা প্রায় ১-১৫ মিনিট। তিনি আমাকে দেখেন ও আমার গলায় একটা কালো সুতোয় একটা শিকড় বেঁধে পড়িয়ে দেন ও একটা ছোট তেলের শিশিতে ফুঁ দিয়ে মন্ত্র পড়ে, ঐ মন্ত্র পড়া সরষের তেল দিনে মালিশ করবেন এবং গরম সেঁক দিতে বলেন। তিনি আমাকে আরও বলেন যে এখন থেকে আর কোন ডাক্তারের ওষুধ খেতে হবে না। 

এখানে উপস্থিত প্রত্যেক রোগীকেই তিনি আমার মত একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করছিলেন। 

আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে কোন ‘ড্রাগ লাইসেন্স’ ছাড়াই প্রতি শনি ও মঙ্গলবার তিনি অসংখ্য মানুষকে এইভাবে অলৌকিক চিকিৎসা করে চলেছেন, যা আইনত সম্পূর্ণ বে-আইনি। 

আপনার কাছে আমি শ্রীমতী লক্ষ্মী মণ্ডলের বিরুদ্ধে ড্রাগ এন্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০ অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আবেদন করছি। 

আশাকরি জনস্বার্থে আপনি আমার আবেদন গ্রহণ করবেন বাধিত করবেন। 

                                                                           ধন্যবাদ

                                                                          শংকর ভড়

                                                                          কলকাতা-৬

এই অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ পদক্ষেপ নেয়। মুখ থুবড়ে পড়ে ‘হাড়ভাঙ্গা বুড়ি’র দৈব চিকিৎসার নামে বুজরুকি ব্যবসা। 


সন্তোষ শর্মা

সংযুক্ত সম্পাদক

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি

কলকাতা - ১২২

মোবাইল : ৯৩৩০৪৫১৯৭৭

ইমেল : rationalist.santosh@gmail.com


আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929